Monday, November 29, 2010

কোন্ দেশে

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
কোন্ দেশেতে তরুলতা
সকল দেশের চাইতে শ্যামল?
কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই
দলতে হয় রে দুর্বা কোমল?

কোথায় ফলে সোনার ফসল,
সোনার কমল ফোটেরে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে!

কোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা
ফিঙে নাচে গাছে গাছে?
কোথায় জলে মরাল চলে,
মরালী তার পাছে পাছে?

বাবুই কোথা বাসা বোনে,
চাতক বারি যাচে রে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে!

সমাপ্ত

ইলশে গুঁড়ি

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম।
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।

কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,
পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,
মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে
আলতা-পাটি শিম্|
ইলশে গুঁড়ি হিমের কুঁড়ি,
রোদ্দুরে রিম্ ঝিম্|

হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায়
ইলশে গুঁড়ির নাচ, -
ইলশে গুঁড়ির নাচন্ দেখে
নাচছে ইলিশ মাছ|

কেউ বা নাচে জলের তলায়
ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়,
নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়,
পুকুরে ছিপ গাছ|
উলসে ওঠে মনটা, দেখে
ইলশে গুঁড়ির নাচ|

ইলশে গুঁড়ি পরীর ঘুড়ি
কোথায় চলেছে,
ঝমরো চুলে ইলশে গুঁড়ি
মুক্তো ফলেছে!

ধানেক বনে চিংড়িগুলো
লাফিয়ে ওঠে বাড়িয়ে নুলো;
ব্যাঙ ডাকে ওই গলা ফুলো,
আকাশ গলেছে,
বাঁশের পাতায় ঝিমোয় ঝিঁঝিঁ,
বাদল চলেছে|

মেঘায় মেঘায় সূর্য্যি ডোবে
জড়িয়ে মেঘের জাল,
ঢাকলো মেঘের খুঞ্চে-পোষে
তাল-পাটালীর থাল|

লিখছে যারা তালপাতাতে
খাগের কলম বাগিয়ে হাতে
তাল বড়া দাও তাদের পাতে
টাটকা ভাজা চাল;
পাতার বাঁশী তৈরী করে’
দিও তাদের কাল|

খেজু পাতায় সবুজ টিয়ে
গড়তে পারে কে?
তালের পাতার কানাই ভেঁপু
না হয় তাদের দে|

ইলশে গুঁড়ি–জলের ফাঁকি
ঝরছে কত বলব তা কী?
ভিজতে এল বাবুই পাখী
বাইরে ঘর থেকে;-
পড়তে পাখায় লুকালো জল
ভিজলো নাকো সে|

ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি!
পরীর কানের দুল,
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি!
ঝরো কদম ফুল|

ইলশে গুঁড়ির খুনসুড়িতে
ঝাড়ছে পাখা–টুনটুনিতে
নেবুফুলের কুঞ্জটিতে
দুলছে দোদুল দুল্;
ইলশে গুঁড়ি মেঘের খেয়াল
ঘুম-বাগানের ফুল|

সমাপ্ত

মানুষ জাতি

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথী।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো,
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙ্গা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ
ভিতরের রং পলকে ফোটে,
বামুন, শূদ্র, বৃহৎ, ক্ষুদ্র
কৃত্রিম ভেদ ধুলায় লোটে।
বংশে বংশে নাহিক তফাত
বনেদি কে আর গর্-বনেদি,
দুনিয়ার সাথে গাঁথা বুনিয়াদ্
দুনিয়া সবারি জনম-বেদী।

সমাপ্ত

অধম ও উত্তম

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তায়।

ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।

বাপেরে সে বলে ভৎসনার-ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
"তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নেই দাঁত !"

কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
"তুই রে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়
দংশি কেমন করে !

কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা ব'লে কুকুরে কামড়ানো কি রে
মানুষের শোভা পায় ?"


সমাপ্ত

ফুলের ফসল

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!

বাজারে বিকায় ফল তণ্ডুল
সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা,
হৃদয়-প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল
দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা!

সমাপ্ত

প্রথম গালি

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
বয়েস-আড়াই কি দুই
মনটি নির্মল জুই,
হালকা যেন হাওয়া
মেয়ে সে মুখ-চাওয়া
মায়ের কাছে কাছে
ছায়ার মত আছে
জানে না মা বিনা কিছুই৷
আর সে দিদি চেনে তার
দিদি সে সাথী খেলিবার,
দুটিতে পিঠোপিঠি
তবুও খিটিমিটি
হয় না বেশী বেশী
নাইক রেষারেষি
কলহ নাইক নিতুই৷
জগৎ মানে যেন,তার−
মা,দিদি আপনি সে আর,
এ ছাড়া কিছুই নেই
চেনেনা কারুকেই,
অকথা কুকথার
ধারে না কোনো ধার
শেখেনি আজও‘তুই’‘মুই’৷
একদা হ’ল দুটি বোনে
পুতুল নিয়ে কি কারণে
ঝগড়া কাড়াকাড়ি,
তখন দিয়ে আড়ি
হারিয়া কাদোঁ-কাদোঁ
হ’য়ে সে আধো আধো
কহিল‘ডিডি!টুমি-টুই!’

সমাপ্ত

দূরের পাল্লা

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ছিপখান তিন দাঁড়-
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা!

পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল-জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নার টাঁকশাল|

কঞ্চির তীর-ঘর
ঐ-চর জাগছে,
বুনো-হাঁস ডিম তার
শ্যাওলায় ঢাকছে|

চুপ চুপ-ওই ডুব
দ্যায় পান্ কৌটি
দ্যায় ডুব টুপ টুপ
ঘোমটার বৌটি!

ঝকঝক কলসীর
বক্ বক্ শোন্ গো
ঘোমটার ফাঁক বয়
মন উন্মন গো|

তিন-দাঁড় ছিপখান
মন্থর যাচ্ছে,
তিনজন মাল্লায়
কোন গান গাচ্ছে?

রূপশালি ধান বুঝি
এইদেশে সৃষ্টি,
ধুপছায়া যার শাড়ী
তার হাসি মিষ্টি|

মুখখানি মিষ্টিরে
চোখদুটি ভোমরা
ভাব-কদমের-ভরা
রূপ দেখ তোমরা!

ময়নামতীর জুটি
ওর নামই টগরী,
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে
জল হোলো গোখরী!

ডাক পাখী ওর লাগি'
ডাক ডেকে হদ্দ,
ওর তরে সোঁত-জলে
ফুল ফোটে পদ্ম|

ওর তরে মন্থরে
নদ হেথা চলছে,
জলপিপি ওর মৃদু
বোল বুঝি বোলছে|

দুইতীরে গ্রামগুলি
ওর জয়ই গাইছে,
গঞ্জে যে নৌকা সে
ওর মুখই চাইছে|

আটকেছে যেই ডিঙা
চাইছে সে পর্শ,
সঙ্কটে শক্তি ও
সংসারে হর্ষ|

পান বিনে ঠোঁট রাঙা
চোখ কালো ভোমরা,
রূপশালী-ধান-ভানা
রূপ দেখ তোমরা
------------------
পান সুপারি! পান সুপারি!
এইখানেতে শঙ্কা ভারি,
পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনে
চলরে টেনে বৈঠা হেনে;
বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে
বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে
বুক দে টানো, বইটা হানো-
সাত সতেরো কোপ কোপানো|

হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো
ডাইনী যেন ঝামর-চুলো
নাচতে ছিল সন্ধ্যাগমে
লোক দেখে কি থমকে গেল|

জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে
রাত্রি এল রাত্রি এল|

ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে
ফিরছে কারা মাছের পাছে,
পীর বদরের কুদরতিতে
নৌকা বাঁধা হিজল-গাছে|
--------------
আর জোর দেড় ক্রোশ-
জোর দের ঘন্টা,
টান ভাই টান সব-
নেই উত্কণ্ঠা|

চাপ চাপ শ্যাওলার
দ্বীপ সব সার সার,
বৈঠৈর ঘায়ে সেই
দ্বীপ সব নড়ছে,
ভিল্ ভিলে হাঁস তায়
জল-গায় চড়ছে|

ওই মেঘ জমছে,
চল্ ভাই সমঝে,
গান গাও দাও শিশ,
বকশিশ! বকশিশ!

খুব জোর ডুব-জল
বয় স্রোত ঝিরঝির,
নেই ঢেউ কল্লোল,
নয় দুর নয় তীর|

নেই নেই শঙ্কা,
চল্ সব ফুর্তি,
বকশিশ টঙ্কা,
বকশিশ ফুর্তি|

ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,
ঝাউ-গাছ দুলছে,
ঢোল-কলমীর ফুল
তন্দ্রায় ঢুলছে|

লকলক শর-বন
বক তায় মগ্ন,
চুপচাপ চারদিক-
সন্ধ্যার লগ্ন|

চারদিক নিঃসাড়,
ঘোর-ঘোর রাত্রি,
ছিপ-খান তিন-দাঁড়,
চারজন যাত্রি|
------------------
জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে
ঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে
ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝিঁর গানে-
স্বপন পানে পরাণ টানে|

তারায় ভরা আকাশ ওকি
ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে
লুটিয়ে পল আচম্বিতে
কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে!
------------------
কেবল তারা! কেবল তারা!
শেষের শিরে মানিক পারা,
হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি
কেবল তারা যেথায় চাহি|

কোথায় এল নৌকাখানা
তারার ঝড়ে হই রে কাণা,
পথ ভুলে কি এই তিমিরে
নৌকা চলে আকাশ চিরে!
জ্বলছে তারা! নিভছে তারা!
মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়,
যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায়
জোনাক যেন পন্থা-হারা|

তারায় আজি ঝামর হাওয়া-
ঝামর আজি আঁধার রাতি,
অগুনতি অফুরান তারা
জ্বালায় যেন জোনাক-বাতি|

কালো নদীর দুই কিনারে
কল্পতরু কুঞ্জ কি রে?
ফুল ফুটেছে ভারে ভারে-
ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে|

বিনা হাওয়ায় ঝিলমিলিয়ে
পাপড়ি মেলে মাণিক-মালা;
বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছে
ফুল পড়িছে জোনাক জ্বালা|

চোখে কেমন লগছে ধাঁধা-
লাগছে যেন কেমন পারা,
তারাগুলোই জোনাক হল
কিম্বা জোনাক হল তারা|

নিথর জলে নিজের ছায়া
দেখছে আকাশ ভরা তারায়,
ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে
জলে জোনাক দিশে হারায়|

দিশে হারায় যায় ভেসে যায়
স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে?
মরা গাঙ আর সুর-সরিত্
এক হয়ে যেথায় মেশে রে!

কোথায় তারা ফুরিয়েছে,আর
জোনাক কোথা হয় সুরু যে
নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা
চোখ যে আলা রতন উঁছে|

আলেয়াগুলো দপদপিয়ে
জ্বলছে নিবে,নিবছে জ্বলে,
উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে
চাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে!

আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা
আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা
একলা ছোটে বন বাদাড়ে
ল্যাম্পো-হাতে লকড়ি ঘাড়ে;
সাপ মানে না, ভাঘ জানেনা,
ভূতগুলো তার সবাই চেনা,
ছুটছে চিঠি পত্র নিয়ে
রণরণিয়ে হনহনিয়ে|

বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,
কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,
জাগছে হাওয়া জলের ধারে,
চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে!

শুকতারাটি আজ নিশীথে
দিচ্ছে আলো পিচকিরিতে,
রাস্তা এঁকে সেই আলোতে
ছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে|

ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,
মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে;
রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে
ধরছে কারা মাছগুলোকে!

চলছে তরী চলছে তরী-
আর কত পথ? আর ক'ঘড়ি?
এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী,
ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি-
ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্
দেখছ আলো? ঐতো কুঠি
ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই
রাতের মতন আজকে ছুটি|

ঝপ ঝপ তিনখান
দাঁড় জোর চলছে,
তিনজন মাল্লার
হাত সব জ্বলছে;
গুরগুর মেঘ সব
গায় মেঘ মল্লার,
দূর-পাল্লার শেষ
হাল্লাক্ মাল্লার!

সমাপ্ত

ছিন্নমুকুল

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
সবচেয়ে যে ছোট পিড়ি খানি
সেখানি আর কেউ রাখেনা পেতে,
ছোটথালায় হয় নাকো ভাতবাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।

সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি,
খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে,
সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি।
ভয়ভরা সে ছিল যে সব চেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।

হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে!
হারিয়ে গেছে 'বোল' বলা সেই বাঁশি
দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী।

সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।

সমাপ্ত

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতাসমূহ –


অধম ও উত্তম
ইলশে গুঁড়ি
কোন্ দেশে
ছিন্নমুকুল
দূরের পাল্লা
প্রথম গালি
ফুলের ফসল
মানুষ জাতি


Tuesday, November 23, 2010

বৃষ্টির ছড়া

কবিঃ ফররুখ আহমেদ
বৃষ্টি এল কাশ বনে
জাগল সাড়া ঘাস বনে,
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।

নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকল দূরে দেয়া যে,
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটল আবার কেয়া যে।

গাঁয়ের নামটি হাটখোলা,
বিষ্টি বাদল দেয় দোলা,
রাখাল ছেলে মেঘ দেখে,
যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা।

মেঘের আঁধার মন টানে,
যায় সে ছুটে কোন খানে,
আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে
আমন ধানের দেশ পানে।

সমাপ্ত

পাঞ্জেরি

কবিঃ ফররুখ আহমেদ
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলার এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায়, জোছনা-মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
আহা, পেরেশান মুসাফির দল।
দরিয়া কিনারে জাগে তক্দিরে
নিরাশায় ছবি এঁকে!
পথহারা এই দরিয়া-সোঁতারা ঘুরে
চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের গান জুলমাত হেরি!

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,
দরিয়া-অথই ভ্রান্তি-নিয়াছি ভুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।
মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।
কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাকার,-ও কি রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ও কি দরিয়ার গর্জন,-ও কি বেদনা মজলুমের!
ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।

পাঞ্জেরি!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!

সমাপ্ত

ঝরোকা

কবিঃ ফররুখ আহমেদ
সকল রুদ্ধ ঝরোকা খুলে দাও
খুলে দাও সকল রুদ্ধ দরোজা।
আসুক সাত আকাশের মুক্ত আলো
আর উচ্ছল আনন্দের মত
বাগে এরেমের এক ঝাঁক মৌমাছি…
যেন এই সব পাথরের ফুলের মাঝখান থেকে
আমি চিনে নিতে পারি
রক্তমনির চেয়েও লাল সুনভিত
একটি তাজা রক্ত গোলাপ;

আমার ব্যথিত আত্মা আর্তনাদ করে উঠলো
দাউদের পুত্র সোলায়মানের মতো
কেননা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আকাশ আছে পৃথিবীতে
চিরন্তন শুধু সত্যের অন্বেষা।

সমাপ্ত

ঝুমকো জবা

কবিঃ ফররুখ আহমেদ
ঝুমকো জবা বনের দুল
উঠল ফুটে বনের ফুল।


সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে,
ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে।


সেই দুলুনির তালে তালে,
মন উড়ে যায় ডালে ডালে।

সমাপ্ত

ফররুখ আহমেদের কবিতাসমূহ –


ঝুমকো জবা
ঝরোকা
পাঞ্জেরি
বৃষ্টির ছড়া


Friday, November 19, 2010

আয় রে বসন্ত

কবিঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
আয় রে বসন্ত তোরও
কিরণ-মাখা পাখা তুলে|
নিয়ে আয় তোর কোকিল পাখির
গানের পাতা গানের ফুলে|

বলে - পড়ি প্রেমফাঁদে
তারা সব হাসে কাঁদে;
আমি শুধুই কুড়ই হাসি -
সুখনদীর উপকূলে|

জানি না ত দুখ কিসে,
চাহি না প্রেমের বিষে,
আমি বনে বেড়িয়ে বেড়াই,
নাচি গাই রে প্রাণ খুলে|

নিয়ে আয় তোর কুসুমরাশি,
তারার কিরণ, চাঁদের হাসি,
মলয়ের ঢেউ নিয়ে আয়
উড়িয়ে দে মোর এলো চুলে|

সমাপ্ত

জন্মভূমি

কবিঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
কি মাধুর্য জন্মভূমি জননি তোমার|
হেরিব কি তোমারে মা নয়নে আবার|
কতদিন আছি ছাড়ি,
তবু কি ভুলিতে পারি,
তবুও জাগিছ মাতঃ হৃদয়ে আমার|

লালত শৈশব যথা যপিত যৌবন,
ভুলিতে যে প্রিয় দৃশ্য চাহে কি গো মন,
প্রতি তরুলতা সনে
মিশ্রিত জড়িত মনে,
স্মৃতিচোখে প্রিয় ছবি হেরি বার বার|

তোমা বিনা অন্য কারে মা বলে ডাকিতে,
কখন বাসনা মাতঃ নাহি হয় চিতে;
অভূষণ শোভারাশি,
মাতঃ তব ভালবাসি;
চাই না সুরম্য স্থান নানা অলঙ্কার|
স্বর্গীয় মাধুর্যময় স্বদেশ আমার|

সমাপ্ত

ক'রো না অপমান

কবিঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
যেই স্থানে আজ কর বিচরণ,
পবিত্র সে দেশ পূণ্যময় স্থান;
ছিল এ একদা দেব লিলাভূমি,
করোনা, করোনা তার অপমান!

আজিও বহিছে গঙ্গা, গোদাবরী
যমুনা, নর্মদা, সিন্ধু বেগবান;
অই আরাবলী, তুঙ্গ হিমগিরি;
করোনা, করোনা তার অপমান|

নাই কি চিতোর, নাই কি দেওয়ার,
পূণ্য হলদিঘাট আজো বর্তমান|
নাই উজ্জয়িনী, অযোধ্যা, হস্তিনা?
করোনা, করোনা তার অপমান|

এ অমরাবতী, প্রতি পদে যার,
দলিত চরণে ভারত-সন্তান;
দেবের পদাঙ্ক আজিও অঙ্কিত,
করোনা, করোনা তার অপমান|

আজো বুদ্ধ-আত্মা, প্রতাপের ছায়া,
ভ্রমিছে হেথায়-হও সাবধান!
আদেশিছে শুন অভ্রান্ত ভাষায়,
করোনা, করোনা তার অপমান|

সমাপ্ত

ধনধান্য পুষ্পভরা

কবিঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা;
তাহার মাঝে আছে দেশ এক-সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি তিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে-আমার জন্মভূমি।

চন্দ্র-সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজল এমন ধারা!
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে!
তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে, ওঠে পাখির ডাকে জেগে,
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে-আমার জন্মভূমি।

এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়;
কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।
এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে-আমার জন্মভূমি।

পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে-
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে-আমার জন্মভূমি।

ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?
ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে-আমার জন্মভূমি।

সমাপ্ত

নন্দলাল

কবিঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ-
স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।
সকলে বলিল,‘আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল?’
নন্দ বলিল,‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?
আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’
তখন সকলে বলিল-‘বাহবা বাহবা বাহবা বেশ।’

নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তারে কেবা!
সকলে বলিল,‘যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা’
নন্দ বলিল, ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-
না হয় দিলাম, কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারিদিক’
তখন সকলে বলিল-‘হাঁ হাঁ হাঁ,তা বটে,তা বটে, ঠিক।’

নন্দ একদা হঠাৎ একটা কাগজ করিল বাহির,
গালি দিয়া সবে গদ্যে, পদ্যে বিদ্যা করিল জাহির;
পড়িল ধন্য দেশের জন্য নন্দ খাটিয়া খুন;
লেখে যত তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায় তার দশ গুণ;
খাইতে ধরিল লুচি ও ছোকা ও সন্দেশ থাল থাল,
তখন সকলে বলিল-‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।’

নন্দ একদা কাগজেতে এক সাহেবকে দেয় গালি;
সাহেব আসিয়া গলাটি তাহার টিপিয়া ধরিল খালি;
নন্দ বলিল,‘আ-হা-হা! কর কি, কর কি! ছাড় না ছাই,
কি হবে দেশের, গলাটিপুনিতে আমি যদি মারা যাই?
বলো কি’ বিঘৎ নাকে দিব খত যা বলো করিব তাহা।’
তখন সকলে বলিল–‘বাহবা বাহবা বাহবা বাহা!’

নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়;
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়,
তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল
সকলে বলিল-‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।’

সমাপ্ত

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতাসমূহ –


আয় রে বসন্ত
ক'রো না অপমান
জন্মভূমি
ধনধান্য পুষ্পভরা
নন্দলাল


Sunday, November 14, 2010

ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত

কবিঃ তসলিমা নাসরিন
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত,
তবু এখনো কেমন যেন হৃদয় টাটায়-
প্রতারক পুরুষেরা এখনো আঙুল ছুঁলে পাথর শরীর বয়ে ঝরনার জল ঝরে।
এখনো কেমন যেন কল কল শব্দ শুনি নির্জন বৈশাখে, মাঘ-চৈত্রে-

ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত,
তবু বিশ্বাসের রোদে পুড়ে নিজেকে অঙ্গার করি।
প্রতারক পুরুষেরা একবার ডাকলেই ভুলে যাই পেছনের সজল ভৈরবী,
ভুলে যাই মেঘলা আকাশ, না-
ফুরানো দীর্ঘ রাত।

একবার ডাকলেই
সব ভুলে পা বাড়াই নতুন ভুলের দিকে,
একবার ভালোবাসলেই
সব ভুলে কেঁদে উঠি অমল বালিকা।

ভুল প্রেমে তিরিশ বছর গেল
সহস্র বছর যাবে আরো,
তবু বোধ হবে না নির্বোধ বালিকার।

সমাপ্ত

পাখি হয়েও ফিরব একদিন

কবিঃ তসলিমা নাসরিন
আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর নেত্রকোনা
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব। ফিরব ভিড়ে হট্টগোল, খরায় বন্যায়
অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের পুকুরে-
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুননেসা, অপেক্ষা করো ঈদুল আরা,
আমি ফিরব। ফিরব ভালবাসতে, হাসতে, জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে-
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারি বইমেলা আমি ফিরব।

মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে কফোটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।

শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।

শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকু-পাহাড়-আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।

সমাপ্ত

এখনো তুমি

কবিঃ তসলিমা নাসরিন
[ রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতা ]

ভালোবাসা বলতে এখনো তোমাকেই বুঝি
ঘৃণা বলতে এখনো তোমাকে
সংসার বলতে এখনো তোমাকে বুঝি
সুখ বলতেও আমি এখনো তোমাকে
কত টুকু পশু আছে, কতটা হিংস্রতা
কতটা দানব থাকে একজন মানুষের দেহে
তোমাকে আমল ছুঁয়ে যেনে, আমি সমস্ত জেনেছি
তোমার তকের নিচে কত টুকু ক্লেদ
কতটা দ্রুদতা
চোখের তারায় তুমি কতটা রুখ পাপ
শরীলের ঘ্রাণ শুকে শুকে আমি সকল বুঝেছি
স্বপ্ন বলতে এখনো তোমাকেই বুঝি
কষ্ট বলতে এখনো তোমাকে
চুম্বনে তোমার লালা থেকে চুষে নেই
সংক্রামক ব্যাধি

তোমাকে আরোগ্য করি
তোমাকে শুশ্রূষা করি
তোমাকে নির্মাণ করি আমার বিনাশে
জীবন বলতে এখনো তোমাকে বুঝি
মৃত্যু বলতেও আমি এখনো তোমাকে।

সমাপ্ত

অভিমান

কবিঃ তসলিমা নাসরিন
কাছে যতটুকু পেরেছি আসতে, জেনো,
দূরে যেতে আমি তারো চেয়ে বেশী পারি।

ভালোবাসা আমি যতটা নিয়েছি লুফে
তারো চেয়ে পারি গোগ্রাসে নিতে ভাল;

জন্মের দায়, প্রতিভার পাপ নিয়ে
নিত্য নিয়ত পাথর সরিয়ে হাঁটি।

অতল নিষেধে ডুবতে ডুবতে ভাসি,
আমার কে আছে একা আমি ছাড়া আর?

সমাপ্ত

তসলিমা নাসরিনের কবিতাসমূহ –


অভিমান
এখনো তুমি
পাখি হয়েও ফিরব একদিন
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত


Wednesday, November 10, 2010

কিশোর

কবিঃ গোলাম মোস্তফা
আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি-পাতার বন্ধনে।

সাগর-জলে পাল তুলে দে' কেউ বা হবো নিরুদ্দেশ,
কলম্বাসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবো নূতন দেশ।
জাগবে সাড়া বিশ্বময়
এই বাঙালি নিঃস্ব নয়,
জ্ঞান-গরিমা শক্তি সাহস আজও এদের হয়নি শেষ।

কেউ বা হবো সেনানায়ক গড়বো নূতন সৈন্যদল,
সত্য-ন্যায়ের অস্ত্র ধরি, নাই বা থাকুক অন্য বল।
দেশমাতাকে পূজবো গো,
ব্যথীর ব্যথা বুঝবো গো,
ধন্য হবে দেশের মাটি, ধন্য হবে অন্নজল।

ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।
আকাশ-আলোর আমরা সুত,
নূত বাণীর অগ্রদূত,
কতই কি যে করবো মোরা-নাইকো তার অন্ত-রে।

সমাপ্ত

জীবন বিনিময়

কবিঃ গোলাম মোস্তফা
বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে, নিদ নাহি চোখে তাঁর-
পুত তাহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে না এবার আর!
চারিধারে তার শনায়ে আসিছে মরণ-অন্ধকার।

রাজ্যের যত বিজ্ঞ হেকিম করিবাজ দরবেশ
এসেছে সবাই, দিতেছে বসিয়া ব্যবস্থা সবিশেষ,
সেবাযত্নের বিধিবিধানে তু্রটি নাহি এক লেশ।

তবু তার সেই দুরন্ত রোগ হটিতেছে নাক হায়,
যত দিন যায়, দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়-
জীবন-প্রদীপ নিভিয়া আসিছে অস্তরবির প্রায়।

শুধাল বাবর ব্যগ্রকনেঠ ভিষকবৃন্দে ডাকি,
‘বল বল আজ সত্যি করিয়া, দিও নাকো মোরে ফাঁকি,
এই রোগ হতে বাদশাজাদার মুক্তি মিলিবে নাকি?

নতমস্তকে রহিল সবাই, কহিল না কোন কথা,
মুখর হইয়া উঠিল তাদের সে নিষ্ঠুর নীরবতা
শেলসম আসি বাবরের বুকে বিঁধির কিসের ব্যথ্যা!

হেনকালে এক দরবেশ উঠি কহিলেন-‘সুলতান,
সবচেয়ে তব শ্রেষ্ঠ যে-ধন দিতে যদি পার দান,
খুশি হয়ে তবে বাঁচার আল্লা-বাদশাজাদার প্রাণ।

শুনিয়া সে কথা কহিল বাবর শঙ্কা নাহিক মানি-
‘তাই যদি হয়, প্রস্তুত আমি দিতে সেই কোরবানি,
সবচেয়ে মোর শ্রেষ্ট যে ধন জানি তাহা আমি জানি।’

এতেক বলিয়া আসন পাতিয়া নিরিবিলি গৃহতল
গভীর ধেয়ানে বসিল বাবর শান্ত অচঞ্চল,
প্রার্থনারত হাতদুটি তার, নয়নে অশ্রুজল।

কহিল কাদিঁয়া–‘হে দয়াল খোদা, হে রহিম রহমান,
মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারি আপন প্রাণ,
তাই নিয়ে প্রভু পুতের প্রাণ কর মোরে প্রতিদান।’

স্তব্ধ-নীরব গৃহতল, মুখে নাহি কারো বাণী,
গভীর রজনী, সুপ্তি-মগন নিখিল বিশ্বরানী,
আকাশে বাতাসে ধ্বনিতেছে যেন গোপন কি কানাকানি।

সহসা বাবর ফুকারি উঠির–‘নাহি ভয় নাহি ভয়’
প্রার্থনা মোর কবুল করেছে আল্লাহ যে দয়াময়,
পুত আমার বাঁচিয়া উঠিবে-মরিবে না নিশ্চয়।’

ঘুরিতে লাগিল পুলকে বাবর পুত্রের চারিপাশ
নিরাশ হৃদয় সে যেন আশার দৃপ্ত জয়োল্লাস,
তিমির রাতের তোরণে তোরণে ঊষার পূর্বাভাস।

সেইদিন হতে রোগ–লক্ষণ দেখা দিল বাবরের,
হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিল শয্যা সে মরণের,
নতুন জীবনে হুমায়ুন ধীরে বাঁচিয়া উঠিল ফের।

মরিল বাবর–না, না ভুল কথা, মৃতু্য কে তার কয়?
মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়,
পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়।

সমাপ্ত

শিশুর পণ

কবিঃ গোলাম মোস্তফা
এই করিনু পণ
মোরা এই করিনু পণ
ফুলের মতো গড়ব মোরা
মোদের এই জীবন।

হাসব মোরা সহজ সুখে
গন্ধ রবে লুকিয়ে বুকে
মোদের কাছে এলে সবার
জুড়িয়ে যাবে মন।

নদী যেমন দুই কূলে তার
বিলিয়ে চলে জল,
ফুটিয়ে তোলে সবার তরে
শস্য, ফুল ও ফল।

তেমনি করে মোরাও সবে
পরের ভাল করব ভবে
মোদের সেবায় উঠবে হেসে
এই ধরণীতল।

সূর্য যেমন নিখিল ধরায়
করে কিরণ দান,
আঁধার দূরে যায় পালিয়ে
জাগে পাখির গান।

তেমনি মোদের জ্ঞানের আলো
দূর করিবে সকল কালো
উঠবে জেগে ঘুমিয়ে আছে
যে সব নীরব প্রাণ।

সমাপ্ত

বনভোজন

কবিঃ গোলাম মোস্তফা
নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।
রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছ ধুম,
বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম।

বাপ মা তাদের ঘুমিয়ে আছে এই সুবিধা পেয়ে,
বনভোজনে মিলেছে আজ দুষ্টু কটি মেয়ে।
বসে গেছে সবাই আজি বিপুল আয়োজনে,
ব্যস্ত সবাই আজকে তারা ভোজের নিমন্ত্রণে।

কেউবা বসে হলদি বাটে কেউবা রাঁধে ভাত,
কেউবা বলে দুত্তুরি ছাই পুড়েই গেল হাত।
বিনা আগুন দিয়েই তাদের হচ্ছে যদিও রাঁধা,
তবু সবার দুই চোখেতে ধোঁয়া লেগেই কাঁদা।

কোর্মা পোলাও কেউবা রাঁধে, কেউবা চাখে নুন,
অকারণে বারে বারে হেসেই বা কেউ খুন।
রান্না তাদের শেষ হল যেই, গিন্নী হল নুরু,
এক লাইনে সবাই বসে করলে খাওয়া শুরু।

ধূলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাদার পিঠে,
মিছিমিছি খেয়া সবাই, বলে-বেজায় মিঠে।
এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে,
পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে।

সমাপ্ত

প্রার্থনা

কবিঃ গোলাম মোস্তফা
অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি
বিচার দিনের স্বামী।
যত গুণগান হে চির মহান
তোমারি অন্তর্যামী।

দ্যুলোক-ভূলোক সবারে ছাড়িয়া
তোমারি চরণে পড়ি লুটাইয়া
তোমারি সকাশে যাচি হে শকতি
তোমারি করুণাকামী।

সরল সঠিক পূণ্য পন্থা
মোদের দাও গো বলি,
চালাও সেপথে-যেপথে তোমার
প্রিয়জন গেছে চলি।

যে-পথে তোমার চির-অভিশাপ
যে-পথে ভ্রান্তি, চির-পরিতাপ
হে মহাচালক,মোদের কখনও
করো না সে পথগামী।

সমাপ্ত

গোলাম মোস্তফার কবিতাসমূহ –


কিশোর
জীবন বিনিময়
প্রার্থনা
বনভোজন
শিশুর পণ


Thursday, November 4, 2010

দেশের বাণী

কবিঃ কায়কোবাদ

কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী?
এ দেশের লোক যারা,
সকলইতো গেছে মারা,
আছে শুধু কতগুলি শৃগাল শকুনি!
সে কথা ভাবিতে হায়
এ প্রাণ ফেটে যায়,
হৃদয় ছাপিয়ে উঠে–চোখ ভরা পানি।
কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী!
এ দেশের লোক যত
বিলাস ব্যসনে রত
এ দেশের দুঃখ কিছু নাহি বুঝে তারা।
দেশ গেল ছারেখারে,
এ কথা বলিব কারে?
ভেবে ভেবে তবু মোর হয়ে গেছে সারা!
প্রাণভরা হাহাকার
চোখ ভরা অশ্রুধার,
এ হৃদি যে হয়ে গেছে মরুভূমি-পারা!
এ দেশের দুঃখ কিছু নাহি বুঝে তারা?

সমাপ্ত


সায়াহ্নে

কবিঃ কায়কোবাদ
হে পান্থ, কোথায় যাও কোন্ দূরদেশে
কার আশে? সে কি তোমা করিছে আহ্বান?
সম্মুখে তামসী নিশা রাক্ষসীর বেশে
শোন না কি চারিদিকে মরণের তান!
সে তোমারে ওহে পান্থ, হাসিমুখে এসে,
সে তোমারে ছলে বলে গ্রাসিবে এখনি |
যেয়োনা একাকী পান্থ, সে দূর বিদেশে,
ফিরে এসো, ওহে পান্থ, ফিরে এসো তুমি|
এ ক্ষুদ্র জীবন লয়ে কেন এত আশা?
জান না কি এ জগত্ নিশার স্বপন?
মায়া মরীচিকী প্রায় স্নেহ ভালবাসা-
জীবনের পাছে ওই রয়েছে মরণ
হে পান্থ হেথায় শুরু আঁধারের স্তর;
মৃত্যুর উপর মৃত্যু, মৃত্যু তার পর!

সমাপ্ত

কে তুমি

কবিঃ কায়কোবাদ
( ১ )
কে তুমি? কে তুমি?
ওগো প্রাণময়ী,
কে তুমি রমণী-মণি!
তুমি কি আমার, হৃদি-পুষ্প-হার
প্রেমের অমিয় খনি!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ২ )
কে তুমি?
তুমি কি চম্পক-কলি?
গোলাপ মতি
তুমি কি মল্লিকা যুথী ফুল্ল কুমুদিনী?
সৌন্দর্যের সুধাসিন্ধু,
শরতের পূর্ণ ইন্দু
আঁধার জীবন মাঝে পূর্ণিমা রজনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৩ )
কে তুমি?
তুমি কি সন্ধ্যার তারা, সুধাংশু সুধা-ধারা
পারিজাত পুষ্পকলি
বিশ্ব বিমোহিনী
অথবা শিশির স্নাতা, অর্ধস্ফুট, অনাঘ্রাতা
প্রণয়-পীযূষ ভরা,সোনার নলিনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৪ )
কে তুমি?
তুমি কি বসন্ত-বালা, অথবা প্রেমের ডালা,
প্রাণের নিভৃত কুঞ্জে
সুধা-নির্ঝরিনী!
অথবা প্রেমাশ্রু-ধারা, শোকে দুঃখে আত্মহারা
প্রেমের অতীত স্মৃতি,
বিধবা রমণী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৫ )
কে তুমি?
তুমি কি আমার সেই
হৃদয়-মোহিনী?
সেই যদি,-কেন দূরে? এস, এই হৃদি-পুরে
এস' প্রিয়ে প্রাণময়ী,
এস' সুহাসিনী!
এস' যাই সেই দেশে,-ফুল ফুটে চাঁদ হাসে
দয়েলা কোয়েলা গায়
প্রাণের রাগিণী!
জরা নাই-মৃত্যু নাই, প্রণয়ে কলঙ্ক নাই
চল যাই সেই দেশে
এস' সোহাগিনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

সমাপ্ত

প্রেম-প্রতিমা

কবিঃ কায়কোবাদ
( ১ )
আমি দেখিতাম শুধু তারে!
মধুর চাঁদনীময়ী - মধুরা যামিনী,
শশধর হাসিত অম্বরে!
সে থখন ধীরে ধীরে, - এসে এই নদীতীরে,
গাইত প্রেমের গীত মাতায়ে ধরণী ;
তাহার মধুর স্বরে - মুকুতা পড়িত ঝ'রে
নীরবে বহিয়া যেত আকুলা তটিনী!
আমি দেখিতাম শুধু তারে!

( ২ )
সে আমার সুখে দুঃখে প্রাণের সঙ্গিনী!
তারি তরে বেঁচে আছি ভবে!
জীবন-জলধি-পাড়ে, - আর কি পাইব তারে
এক দুই করে আমি মাসদিন গণি!
সে চাঁদ ওঠে না আর, - ঢালে না সে সুধা ধার,
আমি তার সে আমার - শুধু এই জানি!
সে আসিবে কবে!

( ৩ )
তাহারি চরণ চুমি বনকমলিনী
ফুটিয়া উঠিত থরে থরে!
সে নিতি উন্মুক্ত কেশে, - ফুলরাণী-বেশে এসে
দাঁড়াইয়া এই সরঃতীরে
গাইত প্রেমের গান, - আকুল করিয়া প্রাণ
বিহগ শিখিত সেই প্রেমের রাগিনী!
আমি দেখিতাম শুধু তারে!

( ৪ )
সে সদা কুসুম-সাজে এলাইয়া বেণী
আমার এ প্রাণ নিত কেড়ে!
চারিধারে পুষ্প-তরু, - বায়ু ব'ত ঝুরু ঝুরু
কোকিল তুলিত কত কুহু কুহু ধ্বনি!
হেরি তার রূপরাশি, - হেরি তার প্রেমহাসি,
পাপিয়া আকুল প্রাণে হ'ত পাগলিনী!
আমি দেখিতাম শুধু তারে!

( ৫ )
তাহারি রূপের ছটা উজলি ধরণী
ঝরিয়া পড়িত চারি ধারে!
আকাশে চন্দ্রমা-তারা, - তারি প্রেমে মাতোয়ারা
নয়নে খেলিত তার চঞ্চলা দামিনী!
বুকেতে অমৃত-খনি - কণ্ঠে সুধা-নির্ঝরণী
সৌন্দর্য-সরসে সে যে ফুটন্ত নলিনী!
আমি দেখিতাম শুধু তারে!

সমাপ্ত

বিদায়ের শেষ চুম্বন

কবিঃ কায়কোবাদ
( ১ )
আবার, আবার সেই বিদায়-চুম্বন,
আলেয়ার আলো প্রায়,
আঁধারে ডুবায়ে যায়,
স্মৃতিটি রাখিয়া হায় করিতে দাহন!

( ২ )
বিদায়-চুম্বন,
উভয়েরি প্রাণে করে অগ্নি বরিষণ,
উভয়ে উভয় তরে,
আকুলি ব্যাকুলি করে,
উভয়েরি হৃদিস্তরে যাতনা-ভীষণ!
এমনি কঠোর হায় বিদায়-চুম্বন!

( ৩ )
প্রণয়ের মধুমাখা প্রথম চুম্বনে,
শুধু সুখ সমুল্লাস ;
এতে ঘন হাহুতাশ,
কেবলি যে বহে হায় উভয়েরি মনে!

( ৪ )
সে চুম্বনে এ চুম্বনে কি দিব তুলনা,
সে স্বর্গের পরিমল,
এ মর্তের হলাহল,
তাহাতে উল্লাস, এতে কেবলি যাতনা!

( ৫ )
সে যে শরতের স্নিগ্ধ সুধাংশু-কিরণ,
মুহুর্তে মাতায় ধরা,
এ যে শুধু ক্লেশ ভরা
বৈশাখের ঘন ঘোর ঝটিকা ভীষণ!

সমাপ্ত

প্রণয়ের প্রথম চুম্বন

কবিঃ কায়কোবাদ
(১)

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
যবে তুমি মুক্ত কেশে
ফুলরাণী বেশে এসে,
করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?

(২)

প্রথম চুম্বন!
মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!
কত প্রেম কত আশা,
কত স্নেহ ভালবাসা,
বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

(৩)

হায় সে চুম্বনে
কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!
কত হাসি, কত ব্যথা,
আকুলতা, ব্যাকুলতা,
প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

(৪)

সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,
অতৃপ্ত হৃদয় মূলে
ভীষণ ঝটিকা তুলে,
উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

সমাপ্ত

বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা

কবিঃ কায়কোবাদ
বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা আমার জন্মভূমি।
গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে ব’য়ে,
যাহার চরণ চুমি।
ব্রহ্মপুত্র গেয়ে বেড়ায়,
যাহার পূণ্য-গাথা!
সেই-সে আমার জন্মভূমি,
সেই-সে আমার মাতা!
আমার মায়ের সবুজ আঁচল
মাঠে খেলায় দুল!
আমার মায়ের ফুল-বাগানে,
ফুটছে কতই ফুল!
শত শত কবি যাহার
গেয়ে গেছে গাথা!
সেই-সে আমার জন্মভূমি,
সেই-সে আমার মাতা!
আমার মায়ের গোলা ছিল,
ধন ধান্যে ভরা!
ছিল না তার অভাব কিছু,
সুখে ছিলাম মোরা!
বাংলা মায়ের স্নিগ্ধ কোলে,
ঘুমিয়ে রব আমি!
বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা জন্মভূমি!

সমাপ্ত

আযান

কবিঃ কায়কোবাদ
কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর,
বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!

আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,
কি যে এক আকর্ষণে,
ছুটে যাই মুগ্ধমনে
কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।

হৃদয়ের তারে তারে,
প্রাণের শোণিত-ধারে,
কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে-
কত সুধা আছে সেই মধুর আযানে।

নদী ও পাখির গানে তারই প্রতিধ্বনি।
ভ্রমরের গুণ-গানে
সেই সুর আসে কানে
কি এক আবেশে মুগ্ধ নিখিল ধরণী।

ভূধরে, সাগরে জলে
নির্ঝরণী কলকলে,
আমি যেন শুনি সেই আযানের ধ্বনি।

আহা যবে সেই সুর সুমধু স্বরে,
ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে,
প্রাণ করে আনচান,
কি মধুর সে আযান,
তারি প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে।

নীরব নিঝুম ধরা,
বিশ্বে যেন সবই মরা,
এতটুকু শব্দ যবে নাহি কোন স্থানে,

মুয়াযযিন উচ্চৈঃস্বরে
দাঁড়ায়ে মিনার 'পরে
কি সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আযানে!
জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে।

আহা কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর
বাজিল কি সমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।

সমাপ্ত

কায়কোবাদের কবিতাসমূহ –


আযান
কে তুমি
দেশের বাণী
প্রণয়ের প্রথম চুম্বন
প্রেম-প্রতিমা
বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা
বিদায়ের শেষ চুম্বন
সায়াহ্নে


Wednesday, November 3, 2010

স্বদেশ

কবিঃ আহসান হাবীব
এই যে নদী
নদীর জোয়ার
নৌকা সারে সারে,
একলা বসে আপন মনে
বসে নদীর ধারে
এই ছবিটি চেনা।
মনের মধ্যে যখন খুশি
এই ছবিটি আঁকি
এক পাশে তার জারুল গাছে
দুটি হলুদ পাখি,
এমনি পাওয়া এই ছবিটি
কড়িতে নয় কেনা।

মাঠের পরে মাঠ চলেছে
নেই যেন এর শেষ
নানা কাজের মানুষগুলো
আছে নানান বেশ,
মাঠের মানুষ যায় মাঠে আর
হাটের মানুষ হাটে,
দেখে দেখে একটি ছেলের
সারাটাদিন কাটে।
এই ছেলেটির মুখ
সারাদেশের সব ছেলেদের
মুখেতে টুকটুক।
কে তুমি ভাই,
প্রশ্ন করি যখন,
ভালবাসার শিল্পী আমি,
বলবে হেসে তখন।
এই যে ছবি এমনি আঁকা
ছবির মত দেশ,
দেশের মাটি দেশের মানুষ
নানান রকম বেশ,
বাড়ি বাগান পাখ-পাখালি
সব মিলে এক ছবি,
নেই তুলি নেই রং তবুও
আঁকতে পারি সবই।

সমাপ্ত

যে পায় সে পায়

কবিঃ আহসান হাবীব
তুমি ভালো না বাসলেই বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
তুমি ভালো না বাসলেই ভালোবাসা জীবনের নাম
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে
দাঁড়ালে দু’হাত পেতে
ফিরিয়ে দিলেই
বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।

না না বলে ফেরালেই
বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায় না কখনো।
না না বলে ফিরিয়ে দিলেই
ঘাতক পাখির ডাক শুনতে পাই চরাচরময়

সুসজ্জিত ঘরবাড়ি
সখের বাগান
সভামঞ্চে করতালি
জয়ধ্বনি পুষ্পার্ঘ্য ইত্যাদি
সব ফেলে
তোমার পায়ের কাছে অস্তিত্ব লুটিয়ে দিয়ে
তোমাকে না পেলে, জানি
যে পায়, সে পায়
কি অমূল্য ধন।

সমাপ্ত

দোতলার ল্যান্ডিং মুখোমুখি দুজন

কবিঃ আহসান হাবীব
মুখোমুখি ফ্ল্যাট
একজন সিঁড়িতে, একজন দরজায়

: আপনারা যাচ্ছেন বুঝি?
: চলে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব ।
: বছর দুয়েক হল, তাই নয়?
: তারো বেশী। আপনার ডাক নাম শানু, ভালো নাম?
: শাহানা, আপনার?
: মাবু।
: জানি।
: মাহবুব হোসেন। আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন ।
: কে বলেছে। আপনার তো অনার্স ফাইন্যাল, তাই নয়?
: এবার ফাইন্যাল।
: ফিজিক্স এ অনাস’
: কী আশ্চর্য, আপনি কেন ছাড়লেনহঠাৎ?
: মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে বসে...
: সে যাক গে, পা সেরেছে?
: কী করে জানলেন?
: এই আর কিসেরে গেছে ?
: ও কিছুনা, প্যাসেজটা পিছলে ছিল মানে...
: সত্যি নয়। উচুঁ থেকে পড়ে গিয়ে...
: ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো?
: মা বলেছে?
: শুনতে পাই। বছর দুয়েক হল, তাই নয়?
: তারো বেশী। আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে?
: নেবেন? না থাক। রিকসা এল, মা এলেন, যাই।
: আপনি সন্ধ্যে বেলা ওভাবে কখনও পড়বেন না, চোখ যাবে, যাই।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই ।
: যান, আপনার মা আসছেন।
: মা ডাকছেন, যাই।

সমাপ্ত

জোনাকিরা

কবিঃ আহসান হাবীব
তারা-একটি দু'টি তিনটি করে এলো
তখন-বৃষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া
বইছে এলোমেলো,
তারা-একটি দু'টি তিনটি করে এলো।

থই থই থই অন্ধকারে
ঝাউয়ের শাখা দোলে
সেই-অন্ধকারে শন শন শন
আওয়াজ শুধু তোলে।
ভয়েতে বুক চেপে
ঝাউয়ের শাখা, পাখির পাখা
উঠছে কেঁপে কেঁপে ।
তখন-একটি দু'টি তিনটি করে এসে
এক শো দু শো তিন শো করে
ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে

তারা-বললে ও ভাই, ঝাউয়ের শাখা,
বললে ও ভাই পাখি,
অন্ধকারে ভয় পেয়েছো নাকি?
যখন-বললে, তখন পাতার ফাঁকে
কী যেন চমকালো।
অবাক অবাক চোখের চাওয়ায়
একটুখানি আলো।

যখন-ছড়িয়ে গেলো ডালপালাতে
সবাই দলে দলে
তখন-ঝাউয়ের শাখায়-পাখির পাখায়
হীরে-মানিক জ্বলে।
যখন-হীরে-মানিক জ্বলে
তখন-থমকে দাঁড়াঁয় শীতের হাওয়া
চমকে গিয়ে বলে-
খুশি খুশি মুখটি নিয়ে
তোমরা এলে কারা?
তোমরা কি ভাই নীল আকাশের তারা ?

আলোর পাখি নাম জোনাকি
জাগি রাতের বেলা,
নিজকে জ্বেলে এই আমাদের
ভালোবাসার খেলা।
তারা নইকো-নইকো তারা
নই আকাশের চাঁদ
ছোট বুকে আছে শুধুই
ভালোবাসার সাধ।

সমাপ্ত

ইচ্ছা

কবিঃ আহসান হাবীব
মনারে মনা কোথায় যাস?
বিলের ধারে কাটব ঘাস।

ঘাস কি হবে?

বেচব কাল,
চিকন সুতোর কিনব জাল।

জাল কি হবে?

নদীর বাঁকে
মাছ ধরব ঝাঁকে ঝাঁকে।

মাছ কি হবে?

বেচব হাটে,
কিনব শাড়ি পাটে পাটে।

বোনকে দেব পাটের শাড়ি,
মাকে দেব রঙ্গিন হাঁড়ি।

সমাপ্ত

আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে

কবিঃ আহসান হাবীব
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে।
মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি
ইচ্ছে হলেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি
তালে তালে তালের নৌকো
দু’হাতে যাই বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।

পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকা আমার ভাসে
মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে
মাথার ওপর মুচকি হাসে
বিজলী নামের মেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।

আমার ঢেউয়ের সঙ্গে গলাগলি ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা
ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে কাটাই সারাবেলা
দেশ থেকে যাই দেশান্তরে
মনের নৌকো বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।

সমাপ্ত

আমি কোনো আগন্তুক নই

কবিঃ আহসান হাবীব
আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল,
এই নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী পূবের পুকুর,
তার ঝাকড়া ডুমুরের পালে স্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা-
সারা দেশে।

আমি কোনো আগন্তুক নই।
এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন।
আমি জমিলার মা’র
শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে

হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর।
দেখো মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।

আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই।

দু’পাশে ধানের ক্ষেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক।

সমাপ্ত

আহসান হাবীবের কবিতাসমূহ –


আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
ইচ্ছা
জোনাকিরা
দোতলার ল্যান্ডিং মুখোমুখি দুজন
যে পায় সে পায়
স্বদেশ


Tuesday, November 2, 2010

হায়রে মানুষ

কবিঃ আল মাহমুদ
একটু ছিল বয়েস যখন ছোট্ট ছিলাম আমি
আমার কাছে খেলাই ছিল কাজের চেয়ে দামি।
উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা
তারার দেশে উড়তো আমার পরাণ আত্মহারা।
জোছনা রাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ
আমার পিঠে পরীর ডানা পরিয়ে দিতো কেউ।
দেহ থাকতো এই শহরে উড়াল দিতো মন
মেঘের ছিটার ঝিলিক পেয়ে হাসতো দু’নয়ন।

তারায় তারায় হাঁটতো আমার ব্যাকুল দু’টি পা
নীল চাঁদোয়ার দেশে হঠাৎ রাত ফুরাতো না।
খেলার সাথী ছিল তখন প্রজাপতির ঝাঁক
বনভাদালির গন্ধে কত কুটকুটোতো নাক;
কেওড়া ফুলের ঝোল খেয়ে যে কোল ছেড়েছে মা’র
তার কি থাকে ঘরবাড়ি না তার থাকে সংসার?
তারপরে যে কী হলো, এক দৈত্য এসে কবে
পাখনা দুটো ভেঙে বলে মানুষ হতে হবে।
মানুষ হওয়ার জন্য কত পার হয়েছি সিঁড়ি
গাধার মত বই গিলেছি স্বাদ যে কি বিচ্ছিরি।

জ্ঞানের গেলাস পান করে আজ চুল হয়েছে শণ
কেশের বাহার বিরল হয়ে উজাড় হলো বন।
মানুষ মানুষ করে যারা মানুষ তারা কে?
অফিস বাড়ির মধ্যে রোবোট কলম ধরেছে।
নরম গদি কোশন আসন চশমা পরা চোখ
লোক ঠকানো হিসেব লেখে, কম্প্যুটারে শ্লোক।
বাংলাদেশের কপাল পোড়ে ঘূর্ণিঝড়ে চর
মানুষ গড়ার শাসন দেখে বুক কাঁপে থরথর।
‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’-গান শোননি ভাই?
মানুষ হবার ইচ্ছে আমার এক্কেবারে নাই।

সমাপ্ত

সোনালী কাবিন-১

কবিঃ আল মাহমুদ
সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়না হরিণী
যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ন কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোনো ব্যাবসা শিখিনি
দেহ দিলে দেহ পাবে দেহের অধিক মূলধন
আমারতো নেই শখি, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরষ আবৃত করে জলপাই পাতাও থাকবেনা,
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরষ্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।

এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেল সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ মাটির গায়।
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবেকি হে বন্য বালিকা
অভাবের াজগর জেনো তবে আমার টোটেম,
সতেজ খুনের মত এঁকে দেব হিঙুলের টিকা।

সমাপ্ত

লোকে যাকে প্রেম নাম কহে

কবিঃ আল মাহমুদ
এই গতির মধ্যে মনে হয় কি যেন একটা স্থির হয়ে থাকে।
আমাদের চারিদিকে যখন কোনো গতিকেই আমরা থামাতে পারছি না।
সবকিছুই, না কলম না চিন্তা, এমন কি দীর্ঘজীবী বিপ্লবও
মুখ থুবড়ে দ্রুত পেছনে হটে গিয়ে ক্রেনের আংটাকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে–
মহামতি অনড় লেনিনের মূর্তের গলায় উপড়ে ফেলার শিকল পরাতে।
তখন কেন মনে হবে এমন একটা কিছু আছে যা টলছে না?
দ্যাখো তোমার মেয়েটিকে দ্যাখো, দুদিন আগেও যে
কাঁটা বেছে না দিলে সরষে দেয়া পদ্মার ইলিশ পর্যন্ত মুখে তুলতে পারতো না
এখন সে প্রেমের সাথে সাক্ষাতের জন্য উত্তর গোলার্ধের উত্তর প্রান্তে
একাকী উড়াল দিতে টিকেট হাতে নাচছে।
কত দ্রুত আমাদের হাত গলে বেরিয়ে যাওয়া শিশুরা
বিশ্বের ভারসাম্যের দিকে ঘাড় নুইয়ে দৌড়ে গেল।
আর আমরা ভাবলাম-গতিই জীবন।


গতিই যদি জীবন তবে তোমার আমার মধ্যে সুস্থিরতা কি আর অবশিষ্ট থাকে?
এখন তুমি একটা চাদরে নকশা তুলছ।
আর আমি দেখছি তোমার সর্বাঙ্গে লাবণ্যের ঘামে স্থির ছায়ার স্থবিরতা।
তোমার আত্মার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে তোমার অমৃতের আধার দুটি।
যা সন্তানের লেহনে, পানে আর তৃপ্তিতে অফুরন্ত।
ও আমার অবাধ্য দৃষ্টি, তুমি স্থিরতার বেদীর ওপর এই বিশ্বময়ীকে দ্যাখো।
লোকে যাকে সুখে ও যন্ত্রণায় প্রেম নাম কহে।

সমাপ্ত

মাদক

কবিঃ আল মাহমুদ
নিকোটিনের গন্ধ যখন,
ডাকল আমায় ভাই।
গিয়ে আমি অবাক হলাম,
চমকে উঠলাম তাই।
শত শত যুবক যখন
হাঁটে সড়ক পথে
নামি দামি সিগারেট
থাকে তখন তাদের ঠোঁটে।
কেউবা টানে সখের ঘোরে
কেউবা টাকার জোরে।
কারো আবার টাকার অভাব
তাতে কি যায় আসে।
হতাশা আর ব্যর্থতা যাদের
তাদের কথা হলো
সিগারেটই জীবন আমার
বেঁচে থাকার আলো।
মানুষ মাদক খায়না বন্ধু
মাদকই খায় মানুষ।
দুঃখ তাতে পুড়ে নাকো
জীবন পুড়ে যায়।
মাদক ফেলে এসো সবাই
হাতে হাত ধরি
মানব সেবার শপথ করে
নতুন জীবন গড়ি।

সমাপ্ত

ভয়ের চোটে

কবিঃ আল মাহমুদ
অঙ্ক নিয়ে বসলে আমার কখন কী যে হয়
টেবিলটাও পর হয়ে যায় বইগুলো সব ভয়।
ভয়ের চোটে ভাবতে থাকি শহর ভেঙে কেউ
দালান কোঠা বিছিয়ে দিয়ে তোলে খেতের ঢেউ।
রাস্তাগুলো নদী এবং গলিরা সব খাল
ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলো পাল্টে হলো তাল।
মোটরগাড়ি গরুর পালে হাম্বা তুলে হাঁটে
পুলিশগুলো গুলিস্তানে নিড়ানি ঘাস কাটে।
আব্বা হলেন কাকতাড়ুয়া আম্মা হলুদ পাখি
বুবুরা সব ভুঁইকুমড়ো পাতায় ঢেকে রাখি।

সবাই যখন পাল্টে গেছে নিজের ঘরে নাই
আমিই তখন ইচ্ছে মতন খোকন হয়ে যাই।
কেউ বলে না আঁক কষতে কেউ বলে না লেখ্
কেউ ধরে না কানের লতি, কেউ বলে না শেখ্।
ঢাকা শহর, ঢাকা শহর সবুজ হয়ে যাও
কলেজগুলো সর্ষে বাগান ভার্সিটিতে লাউ।

সমাপ্ত

প্রত্যাবর্তনের লজ্জা

কবিঃ আল মাহমুদ
শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম
ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ

জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে।
হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন,
গোছাতে গোছাতেই তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস।

আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি নিহত হয়ে থাকলাম।
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না।
ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়।
লাইলী মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়।
নাহার কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।

আর আমি এঁদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।
কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।

শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে।
চোখের পাতায় শীতের বিন্দু জমতে জমতে
নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ লাল সূর্য উঠে আসবে।
পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ নামলে,
সামনে দেখবো পরিচিত নদী।
ছড়ানো ছিটানো ঘরবাড়ি, গ্রাম।
জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে।
তারপর দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছোট বাগান।

দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে।
বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু
করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান…।

বাসি বাসন
হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা।
তুই না থাকলে ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়।
হাত মুখ ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।

আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের
লজ্জাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলবো।

সমাপ্ত

পাখির মতো

কবিঃ আল মাহমুদ
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।

আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।

সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।

তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো!

তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।

সমাপ্ত

নোলক

কবিঃ আল মাহমুদ
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।

জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।

কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো!
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।

সমাপ্ত

না ঘুমানোর দল

কবিঃ আল মাহমুদ
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাদঁ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে এলেম ঘর
ঘুমন্ত এই মস্ত শহর করছিলো থরথর।
মিনারটাকে দেখছি যেন দাড়িয়ে আছেন কেউ,
পাথরঘাটার গির্জেটা কি লাল পাথরের ঢেউ?

চৌকিদারের হাক শুনে যেই মোড় ফিরেছি বায়-
কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিল আয় আয়।
পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লাল দিঘীটার পাড়
এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার।
আমায় দেখে কলকলিয়ে দীঘির কালো জল
বললো, এসো, আমরা সবাই না ঘুমানোর দল-
পকেট থেকে খুলো তোমার পদ্য লেখার ভাজঁ
রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ।
দীঘির কথায় উঠলো হেসে ফুল পাখিদের সব
কাব্য হবে, কাব্য হবে-জুড়লো কলরব।

কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই।

সমাপ্ত

দিন শেষে

কবিঃ আল মাহমুদ
আলো আঁধারির খেলায়,
দাঁড়িয়েছি শেষ বেলায়
চোখে মুখে এসে পড়েছে তোমার কেশ
পাখিরা গাইছে বেলা শেষ; খেলা শেষ।

তবু যে কিসের গন্ধে উতলা মন
আমাকে টানছে ইশারায় অনুক্ষণ

আমিও চলেছি প্রবল হাওয়ার ঠেলায়
কোথায় চলেছি; অদৃষ্টের কোন মেলায়।

সমাপ্ত

কদম ফুলের ইতিবৃত্ত

কবিঃ আল মাহমুদ
আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি বৃক্ষের মতো অনড় নই
তুমি যতবার ফিরে এসেছ ততবারই ভেবেছ
আমি কদমবৃক্ষ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকব
কিন্তু এখন দেখ আমি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও
হয়ে গিয়েছি বৃক্ষের অধিক এক কম্পমান সত্তা
বাঁশি বাজিয়ে ফুঁ ধরেছি আর চতুর্দিক থেকে কেঁদে উঠেছে রাধারা
আমি কি বলেছিলাম ঘর ভেঙে আমার কাছে এসো
আমি কি বলেছিলাম যমুনায় কলস ভাসিয়ে
সিক্ত অঙ্গে কদমতলায় মিলিত হও?
আমি তো বলিনি লাজ লজ্জা সংসার সম্পর্ক যমুনার জলে ভাসিয়ে দাও
আমি তো নদীর স্বভাব জানি স্রোত বুঝি কূল ভাঙা বুঝি
কিন্তু তোমাকে বুঝতে বাঁশিতে দেখ কতগুলো ছিদ্র
সব ছিদ্র থেকেই ফুঁ বেরোয়
আর আমার বুক থেকে রক্ত।

সমাপ্ত

একুশের কবিতা

কবিঃ আল মাহমুদ
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।

হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!

প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।

চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে?

পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।

প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।

সমাপ্ত

ঊনসত্তরের ছড়া-১

কবিঃ আল মাহমুদ
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।

কেন বাঁধবো দোর জানালা
তুলবো কেন খিল?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
ফিরবে সে মিছিল।

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
মতিয়ুরকে ডাক।

কোথায় পাবো মতিয়ুরকে
ঘুমিয়ে আছে সে !
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।

সমাপ্ত

আল মাহমুদের কবিতাসমূহ –


ঊনসত্তরের ছড়া-১
একুশের কবিতা
কদম ফুলের ইতিবৃত্ত
দিন শেষে
না ঘুমানোর দল
নোলক
পাখির মতো
প্রত্যাবর্তনের লজ্জা
ভয়ের চোটে
মাদক
লোকে যাকে প্রেম নাম কহে
সোনালী কাবিন-১
হায়রে মানুষ


Monday, November 1, 2010

বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা

কবিঃ আবুল হাসান
মনে আছে একবার বৃষ্টি নেমেছিল?
একবার ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থেমেছিল
আমাদের ইস্টিশনে সারাদিন জল ডাকাতের মতো
উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল তারা;
ছোট-খাটো রাজনীতিকের মতো পাড়ায়-পাড়ায়
জুড়ে দিয়েছিল অথই শ্লোগান।
তবু কেউ আমাদের কাদা ভেঙে যাইনি মিটিং-এ
থিয়েটার পণ্ড হলো, এ বৃষ্টিতে সভা আর
তাসের আড্ডার লোক ফিরে এলো ঘরে;
ব্যবসার হলো ক্ষতি দারুণ দুর্দশা,
সারাদিন অমুক নিপাত যাক, অমুক জিন্দাবাদ
অমুকের ধ্বংস চাই বলে আর হাবিজাবি হলোনা পাড়াটা।
ভদ্রশান্ত কেবল কয়েকটি গাছ বেফাঁস নারীর মতো
চুল ঝাড়ানো আঙ্গিনায় হঠাৎ বাতাসে আর
পাশের বাড়ীতে কোনো হারমোনিয়ামে শুধু উঠতি এক আগ্রহী গায়িকা
স্বরচিত মেঘমালা গাইলো তিনবার!
আর ক’টি চা’খোর মানুষ এলো
রেনকোট গায়ে চেপে চায়ের দোকানে;
তাদের স্বভাবসিদ্ধ গলা থেকে শোনা গেল:
কী করি বলুন দেখি, দাঁত পড়ে যাচ্ছে তবু মাইনেটা বাড়ছেনা,
ডাক্তারের কাছে যাই তবু শুধু বাড়ছেই ক্রমাগত বাড়ছেই
হৃদরোগ, চোখের অসুখ!
একজন বেরসিক রোগী গলা কাশলো:
ওহে ছোকরা, নুন চায়ে এক টুকরো বেশী লেবু দিও।
তাদের বিভিন্ন সব জীবনের খুঁটিনাটি দুঃখবোধ সমস্যায় তবু
সেদিন বৃষ্টিতে কিছু আসে যায়নি আমাদের
কেননা সেদিন সারাদিন বৃষ্টি পড়েছিল,
সারাদিন আকাশের অন্ধকার বর্ষণের সানুনয় অনুরোধে
আমাদের পাশাপাশি শুয়ে থাকতে হয়েছিল সারাদিন
আমাদের হৃদয়ে অক্ষরভরা উপন্যাস পড়তে হয়েছিল !

সমাপ্ত

বন্ধুকে মনে রাখার কিছু-৩

কবিঃ আবুল হাসান
নরক-শয্যায় বৃথা আমাদের শূণ্য হুতাশন,
আজ মনে হয়ঃ নিরন্তর শোকের হাতের
আঙ্গুল আমরা সব!
কিছু-নেই-দুঃখের ভেতর ধ্বংসময় ক্ষণিক পাগল!

যেখানে প্রশান্তি নেই মানুষের লোকক্ষত গাঁথা,
সেখানে মৃত্যু, শুধু মৃতের ঘুমের অন্ধকার;
গ্রীনরোডের পুষ্পিত শাড়ীর মতো
মনে হয়না পৃথিবীকে তাই আর,
ইসলামপুরের পুষ্পস্তবকের মতো
পৃথিবীর নারীর হৃদয়!

তাই বলি তোমাদের একমাত্র মৃত্যুই সুন্দর
চাঁদের মতোন আত্মা আমার মেলে দিতে পারি
আজ অনন্ত মৃত্যু সম্ভাষণে।

সমাপ্ত

বন্ধুকে মনে রাখার কিছু-২

কবিঃ আবুল হাসান
দল বেঁধে সিনেমায় ঢুকে
মনে পড়ে যায় যদি আমাকে সবার কোনোদিন
দীর্ঘায়িত পর্দার অলৌকিক স্পর্শে সেদিন
পরিপূর্ণ শিহরনময় একটি দুঃখের দৃশ্যে
আমাকে খুঁজবে তুমি?
ঘরে ফিরে যাবার বেলায় মনে হবে?
নাকি, সে-রাতের কথা আকস্মাৎ দগ্ধ কোরে দেবে?
যে রাত্রে অর্থহীন পাগলের মতো
কী সে এক দুর্মর আকাঙ্খায়
শহরের শব্দহীন রাস্তায় সারারাত ঘুরে
শৈশবের পুরনো ইতিহাস
ইন্দ্রধনুর মতো পরেছি যখন চোখে মুখে!
এবং সমস্ত নারীর প্রেম-পাপে
ঘুমহীন নিয়নের মতো এই দেহ
টাঙ্গিয়ে দিয়েছি শেষ রাত্রির বিনিদ্র বাতাসে।
এক মূ্র্ছিত ঠোঁটে
পরম দুঃখে গেয়ে গেছিঃ
সহজ উপায় নেই কোনো স্বপ্নহীনতার?

সমাপ্ত

বন্ধুকে মনে রাখার কিছু-১

কবিঃ আবুল হাসান
একদিন ঝরা পাতার মতো নামহীন নিঃশব্দে
তোমাদের কাছ থেকে ঝরে যাবো যখোন
পিছনে ফেলে রেখে আমার নিদ্রাহীনতার কয়েক গুচ্ছ ফুল।

সম্ভব হবে না আর তোমাদের সাথে
রেস্তোরাঁর স্বগত সন্ধান।
সন্ধ্যেবেলা ইসলামপুর থেকে একতোড়া ফুল কিনে নিয়ে
গ্রীন রোড়ের নিষ্ফলতায় ফেলে আসা।

তোমরা তখন ভেবো একদিন কথাচ্ছলে
কোনো আমি এক জোড়া চোখের অবিনশ্বর সান্নিধ্যে
কী এক অমোঘ আলোয়
তার ব্লাউজের গন্ধময় চিত্র গেঁথে গেঁথে
আঁকতে চেয়েছি রক্তময় লাল নাশপাতি!

সমাপ্ত

বদলে যাও, কিছুটা বদলাও

কবিঃ আবুল হাসান
কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী
কিছুটা বদলাতে হবে সুর
সাতটি ছিদ্রের সূর্য; সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর
কিছুটা বদলাতে হবে

মাটির কনুই, ভাঁজ
রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে

বদলে দাও, তুমি বদলাও
নইলে এক্ষুনি
ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী,
যখন যেখানে পাবে
মেরে রেখে যাবে,
তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও।
বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও!

সমাপ্ত

প্রশ্ন

কবিঃ আবুল হাসান
চোখ ভরে যে দেখতে চাও
রঞ্জন রশ্মিটা চেনো তো?
বুক ভরে যে শ্বাস নিতে চাও
জানো তো অক্সিজেনের পরিমাণটা কত?
এত যে কাছে আসতে চাও
কতটুকু সংযম আছে তোমার?
এত যে ভালোবাসতে চাও
তার কতটুকু উত্তাপ সইতে পারবে তুমি?

সমাপ্ত

প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী

কবিঃ আবুল হাসান
অতো বড় চোখ নিয়ে, অতো বড় খোঁপা নিয়ে
অতো বড় দীর্ঘশ্বাস বুকের নিশ্বাস নিয়ে
যতো তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারশ
যতো তুমি খুলে দাও ঘরের পাহারা
যতো আনো ও-আঙ্গুলে অবৈধ ইশারা
যতো না জাগাও তুমি ফুলের সুরভী
আঁচলে আগলা করো কোমলতা, অন্ধকার
মাটি থেকে মৌনতার ময়ূর নাচাও কোন
আমি ফিরব না আর, আমি কোনদিন
কারো প্রেমিক হবো না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ
আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো।

সমাপ্ত

নিঃসঙ্গতা

কবিঃ আবুল হাসান
অতোটুকু চায় নি বালিকা!
অতো শোভা, অতো স্বাধীনতা!
চেয়েছিলো আরো কিছু কম,

আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিলো
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!

অতোটুকু চায় নি বালিকা!
অতো হৈ রৈ লোক, অতো ভিড়, অতো সমাগম!
চেয়েছিলো আরো কিছু কম!

একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিলো

একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!

সমাপ্ত

তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না

কবিঃ আবুল হাসান
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’ শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো; তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
এখন তোমার কাছে যাবো; তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা–
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো
আমি আঁধার রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভীর দুধের সাদা
হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত
যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না–তোমার চিবুকে
তারা নিশ্চয়ই আছেন!

তোমার চিবুকে সেই গাভীর দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি
কাছে আয় পুরনো রাখাল!
আমি কাছে যাবো আমি তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না!

সমাপ্ত

একলা বাতাস

কবিঃ আবুল হাসান
নোখের ভিতর নষ্ট ময়লা,
চোখের ভিতর প্রেম,
চুলের কাছে ফেরার বাতাস
দেখেই শুধালেম,

এখন তুমি কোথায় যাবে?
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে
রক্তে কি প্রব্লেম?

হঠাৎ তাহার ছায়ায় আমি যেদিকে তাকালেম
তাহার শরীর মাড়িয়ে দিয়ে
দিগন্তে দুইচক্ষু নিয়ে
আমার দিকে তাকিয়ে আমি আমাকে শুধালেম

এখন তুমি কোথায় যাবে?
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে
রক্তে কি প্রব্লেম?

সমাপ্ত

আকাঙ্খা

কবিঃ আবুল হাসান
তুমি কি আমার আকাশ হবে?
মেঘ হয়ে যাকে সাজাব
আমার মনের মত করে।

তুমি কি আমার নদী হবে?
যার নিবিড় আলিঙ্গনে ধন্য হয়ে
তরী বেশে ভেসে যাব কোন অজানা গন্তব্যের পথে।

তুমি কি আমার জোছনা হবে?
যার মায়াজালে বিভোর হয়ে
নিজেকে সঁপে দেব সকল বাস্তবতা ভুলে।

তুমি কি আমার কবর হবে?
যেখানে শান্তির শীতল বাতাসে
বয়ে যাবে আমার চিরনিদ্রার অফুরন্ত প্রহর।

সমাপ্ত

অপরূপ বাগান

কবিঃ আবুল হাসান
চলে গেলে-তবু কিছু থাকবে আমার: আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল:
নদীর প্রবাহপলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার-অনড় শামুক!

তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি-তা হলে এচোখ
মাথার খুলির নীচে নরোম নির্জন এক অবিনাশী ফুল:
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি?

জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন!
তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি!

অনুপস্থিতি হবে আমার একলা ঘর, আমার বসতি!

ফিরে যাবো সংগোপনে, জানবে না, চিনবে না কেউ;
উঠানে জন্মাবো কিছু হাহাকার, অনিদ্রার গান-

আর লোকে দেখে ভাববে-বিরহবাগান ঐ উঠানে তো বেশ মানিয়েছে!

সমাপ্ত

আবুল হাসানের কবিতাসমূহ –


অপরূপ বাগান
আকাঙ্খা
একলা বাতাস
তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না
নিঃসঙ্গতা
প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী
প্রশ্ন
বদলে যাও, কিছুটা বদলাও
বন্ধুকে মনে রাখার কিছু-১
বন্ধুকে মনে রাখার কিছু-২
বন্ধুকে মনে রাখার কিছু-৩
বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা