Showing posts with label জীবনমুখী কবিতা. Show all posts
Showing posts with label জীবনমুখী কবিতা. Show all posts

Friday, December 17, 2010

ছাড়পত্র

কবিঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবেস্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক'রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।

সমাপ্ত

সব্যসাচী

কবিঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য
অভুক্ত শ্বাপদচক্ষু নিঃস্পন্দ আঁধারে
জ্বলে রাত্রিদিন।
হে বন্ধু, পশ্চাতে ফেলি অন্ধ হিমগিরি
অনন্ত বাধ্যক্য তব ফেলুক নিঃশ্বাস;
রক্তলিপ্ত যৌবনের অন্তিম পিপাসা
নিষ্ঠুর গর্জনে আজ অরণ্য ধোঁয়ায়
উঠুক প্রজ্বলি'।
সপ্তরথী শোনে নাকো পৃথিবীর শৈশবক্রন্দন,
দেখে নাই নির্বাকের অশ্রুহীন জ্বালা।
দ্বিধাহীন চণ্ডালের নির্লিপ্ত আদেশে।
আদিম কুক্কুর চাহে
ধরণীর বস্ত্র কেড়ে নিতে।
উল্লাসে লেলিহ জিহ্‌ব লুব্ধ হায়েনারা-
তবু কেন কঠিন ইস্পাত
জরাগ্রস্ত সভ্যতার হৃদপিণ্ড জর্জর,
ক্ষুৎপিপাসা চক্ষু মেলে
মরণের উপসর্গ যেন।
স্বপ্নলব্ধ উদ্যমের অদৃশ্য জোয়ারে
সংঘবদ্ধ বল্মীকের দল।
নেমে এসো-হে ফাল্গুনী,
বৈশাখের খরতপ্ত তেজে
ক্লান্ত দু'বাহু তব লৌহময় হোক
বয়ে যাক শোণিতের মন্দাকিনী স্রোত;
মুমূর্ষু পৃথিবী উষ্ণ, নিত্য তৃষাতুরা,
নির্বাপিত আগ্নেয় পর্বত
ফিরে চায় অনর্গল বিলুপ্ত আতপ।
আজ কেন সূবর্ণ শৃঙ্খলে
বাঁধা তব রিক্ত বজ্রপাণি,
তুষারের তলে সুপ্ত অবসন্ন প্রাণ?
তুমি শুধু নহ সব্যসাচী,
বিস্মৃতির অন্ধকার পারে
ধূসর গৈরিক নিত্য প্রান্তহীন বেলাভুমি 'পরে
আত্মভোলা, তুমি ধনঞ্জয়।।

সমাপ্ত

Sunday, December 12, 2010

ষোলা আনাই মিছে

কবিঃ সুকুমার রায়
বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে
মাঝিরে কন,“বলতে পারিস্ সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফেলিয়ে হাসে।

বাবু বলেন, “সারা জনম মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি!”
খানিক বাদে কহেন বাবু,”বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেম্নে আসে পাহাড় হতে নেবে?

বলত কেন লবনপোরা সাগরভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, “আরে মশাই, অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, “এই বয়সে জানিসনেও তাকি?
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাকি।”

আবার ভেবে কহেন বাবু, “বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলত দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, “আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”

বাবু বলেন, “বলব কি আর, বলব তোরে কি তা,
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুবল বুঝি দুলে।

মাঝিরে কন, “একি আপদ! ওরে ওভাই মাঝি,
ডুবল নাকি নৌকো এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাঁতার জানো? মাথা নাড়েন বাবু”
মুর্খ মাঝি বলে, “মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব কারো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে!”

সমাপ্ত

Wednesday, December 8, 2010

এক জন্ম

কবিঃ তারাপদ রায়
অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।

তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

সমাপ্ত

Monday, November 29, 2010

অধম ও উত্তম

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তায়।

ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।

বাপেরে সে বলে ভৎসনার-ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
"তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নেই দাঁত !"

কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
"তুই রে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়
দংশি কেমন করে !

কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা ব'লে কুকুরে কামড়ানো কি রে
মানুষের শোভা পায় ?"


সমাপ্ত

ছিন্নমুকুল

কবিঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
সবচেয়ে যে ছোট পিড়ি খানি
সেখানি আর কেউ রাখেনা পেতে,
ছোটথালায় হয় নাকো ভাতবাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।

সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি,
খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে,
সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি।
ভয়ভরা সে ছিল যে সব চেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।

হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে!
হারিয়ে গেছে 'বোল' বলা সেই বাঁশি
দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী।

সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।

সমাপ্ত

Friday, November 19, 2010

নন্দলাল

কবিঃ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ-
স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।
সকলে বলিল,‘আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল?’
নন্দ বলিল,‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?
আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’
তখন সকলে বলিল-‘বাহবা বাহবা বাহবা বেশ।’

নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তারে কেবা!
সকলে বলিল,‘যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা’
নন্দ বলিল, ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-
না হয় দিলাম, কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারিদিক’
তখন সকলে বলিল-‘হাঁ হাঁ হাঁ,তা বটে,তা বটে, ঠিক।’

নন্দ একদা হঠাৎ একটা কাগজ করিল বাহির,
গালি দিয়া সবে গদ্যে, পদ্যে বিদ্যা করিল জাহির;
পড়িল ধন্য দেশের জন্য নন্দ খাটিয়া খুন;
লেখে যত তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায় তার দশ গুণ;
খাইতে ধরিল লুচি ও ছোকা ও সন্দেশ থাল থাল,
তখন সকলে বলিল-‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।’

নন্দ একদা কাগজেতে এক সাহেবকে দেয় গালি;
সাহেব আসিয়া গলাটি তাহার টিপিয়া ধরিল খালি;
নন্দ বলিল,‘আ-হা-হা! কর কি, কর কি! ছাড় না ছাই,
কি হবে দেশের, গলাটিপুনিতে আমি যদি মারা যাই?
বলো কি’ বিঘৎ নাকে দিব খত যা বলো করিব তাহা।’
তখন সকলে বলিল–‘বাহবা বাহবা বাহবা বাহা!’

নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়;
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়,
তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল
সকলে বলিল-‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।’

সমাপ্ত

Wednesday, November 10, 2010

জীবন বিনিময়

কবিঃ গোলাম মোস্তফা
বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে, নিদ নাহি চোখে তাঁর-
পুত তাহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে না এবার আর!
চারিধারে তার শনায়ে আসিছে মরণ-অন্ধকার।

রাজ্যের যত বিজ্ঞ হেকিম করিবাজ দরবেশ
এসেছে সবাই, দিতেছে বসিয়া ব্যবস্থা সবিশেষ,
সেবাযত্নের বিধিবিধানে তু্রটি নাহি এক লেশ।

তবু তার সেই দুরন্ত রোগ হটিতেছে নাক হায়,
যত দিন যায়, দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়-
জীবন-প্রদীপ নিভিয়া আসিছে অস্তরবির প্রায়।

শুধাল বাবর ব্যগ্রকনেঠ ভিষকবৃন্দে ডাকি,
‘বল বল আজ সত্যি করিয়া, দিও নাকো মোরে ফাঁকি,
এই রোগ হতে বাদশাজাদার মুক্তি মিলিবে নাকি?

নতমস্তকে রহিল সবাই, কহিল না কোন কথা,
মুখর হইয়া উঠিল তাদের সে নিষ্ঠুর নীরবতা
শেলসম আসি বাবরের বুকে বিঁধির কিসের ব্যথ্যা!

হেনকালে এক দরবেশ উঠি কহিলেন-‘সুলতান,
সবচেয়ে তব শ্রেষ্ঠ যে-ধন দিতে যদি পার দান,
খুশি হয়ে তবে বাঁচার আল্লা-বাদশাজাদার প্রাণ।

শুনিয়া সে কথা কহিল বাবর শঙ্কা নাহিক মানি-
‘তাই যদি হয়, প্রস্তুত আমি দিতে সেই কোরবানি,
সবচেয়ে মোর শ্রেষ্ট যে ধন জানি তাহা আমি জানি।’

এতেক বলিয়া আসন পাতিয়া নিরিবিলি গৃহতল
গভীর ধেয়ানে বসিল বাবর শান্ত অচঞ্চল,
প্রার্থনারত হাতদুটি তার, নয়নে অশ্রুজল।

কহিল কাদিঁয়া–‘হে দয়াল খোদা, হে রহিম রহমান,
মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারি আপন প্রাণ,
তাই নিয়ে প্রভু পুতের প্রাণ কর মোরে প্রতিদান।’

স্তব্ধ-নীরব গৃহতল, মুখে নাহি কারো বাণী,
গভীর রজনী, সুপ্তি-মগন নিখিল বিশ্বরানী,
আকাশে বাতাসে ধ্বনিতেছে যেন গোপন কি কানাকানি।

সহসা বাবর ফুকারি উঠির–‘নাহি ভয় নাহি ভয়’
প্রার্থনা মোর কবুল করেছে আল্লাহ যে দয়াময়,
পুত আমার বাঁচিয়া উঠিবে-মরিবে না নিশ্চয়।’

ঘুরিতে লাগিল পুলকে বাবর পুত্রের চারিপাশ
নিরাশ হৃদয় সে যেন আশার দৃপ্ত জয়োল্লাস,
তিমির রাতের তোরণে তোরণে ঊষার পূর্বাভাস।

সেইদিন হতে রোগ–লক্ষণ দেখা দিল বাবরের,
হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিল শয্যা সে মরণের,
নতুন জীবনে হুমায়ুন ধীরে বাঁচিয়া উঠিল ফের।

মরিল বাবর–না, না ভুল কথা, মৃতু্য কে তার কয়?
মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়,
পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়।

সমাপ্ত

Friday, October 15, 2010

কাজের লোক

কবিঃ নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই।
ওই ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই।

ছোট পাখি, ছোট পাখি
কিচিমিচি ডাকি ডাকি
কোথা যাও বলে যাও শুনি।
এখন না কব কথা
আনিয়াছি তৃণলতা
আপনার বাসা আগে বুনি।

পিপীলিকা, পিপীলিকা
দলবল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।
শীতের সঞ্চয় চাই
খাদ্য খুঁজিতেছি তাই
ছয় পায়ে পিলপিল চলি।

সমাপ্ত

Tuesday, October 12, 2010

কাজলা দিদি

কবিঃ যতীন্দ্র মোহন বাগচী
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে,
থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই,
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?

সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন,
দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?

বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে,
আমিও যদি লুকাই গিয়ে,
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই-কেমন মজা হবে।

ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে,
বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!

বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে,
ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই,
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?

সমাপ্ত

Saturday, October 9, 2010

পারিব না

কবিঃ কালী প্রসন্ন ঘোষ
পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব এক বার,
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা,
পার কি না পার কর যতন আবার
এক বারে না পারিলে দেখ শত বার।

পারিব না বলে মুখ করিও না ভার,
ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার,
অলস অবোধ যারা
কিছুই পারে না তারা,
তোমায় তো দেখি নাক তাদের আকার
তবে কেন পারিব না বল বার বার?

জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখিতে হলে
আগে তব নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বার বার
পারিব বলিয় সুখে হও আগুয়ান।

সমাপ্ত

Friday, October 8, 2010

পাছে লোকে কিছু বলে

কবিঃ কামিনী রায়
করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে-
পাছে লোকে কিছু বলে।

আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে।

হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।

কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
সযতনে শুকায়ে রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।

একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।

মহৎ উদ্দেশ্য যবে,
এক সাথে মিলে সবে,
পারি না মিলিতে সেই দলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।

বিধাতা দেছেন প্রাণ
থাকি সদা ম্রিয়মাণ;
শক্তি মরে ভীতির কবলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।

সমাপ্ত

Sunday, October 3, 2010

শিক্ষকের মর্যাদা

কবিঃ কাজী কাদের নেওয়াজ
বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ-শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার গালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।
তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ”শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা”
শিক্ষক কন-”জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?”
বাদশাহ্ কহেন,”সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
”আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”

সমাপ্ত

Tuesday, June 8, 2010

সাহেব ও মোসাহেব

কবিঃ কাজী নজরুল ইসলাম
সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে!
হুজুরের মতে অমত কার?”

সাহেব কহেন, “কী চমৎকার,
বলতেই দাও, আহা হা!”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের কথা শুনেই বুঝেছি,
বাহাহা বাহাহা বাহাহা!”

সাহেব কহেন, “কথাটা কি জান? সেদিন-”
মোসাহেব বলে, “জানি না আবার?
ঐ যে, কি বলে, যেদিন-”

সাহেব কহেন, “সেদিন বিকেলে
বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।”
মোসাহেব বলে, “আহা হা, শুনেছ?
কিবা অপরুপ গল্প!”

সাহেব কহেন, “আরে ম’লো! আগে
বলতেই দাও গোড়াটা!”
মোসাহেব বলে, “আহা-হা গোড়াটা! হুজুরের গোড়া!
এই, চুপ, চুপ ছোঁড়াটা!”

সাহেব কহেন, “কি বলছিলাম,
গোলমালে গেল গুলায়ে!”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের মাথা! গুলাতেই হবে।
দিব কি হস্ত বুলায়ে?”

সাহেব কহেন, “শোনো না! সেদিন
সূর্য্য উঠেছে সকালে!”
মোসাহেব বলে, “সকালে সূর্য্য? আমরা কিন্তু
দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে!”

সাহেব কহেন, “ভাবিলাম, যাই,
আসি খানিকটা বেড়ায়ে,”
মোসাহেব বলে, “অমন সকাল! যাবে কোথা বাবা,
হুজুরের চোখ এড়ায়ে!”

সাহেব কহেন, “হ’ল না বেড়ানো,
ঘরেই রহিনু বসিয়া!”
মোসাহেব বলে, “আগেই বলেছি! হুজুর কি চাষা,
বেড়াবেন হাল চষিয়া?”

সাহেব কহেন, “বসিয়া বসিয়া
পড়েছি কখন ঝিমায়ে!”
মোসাহেব বলে, “এই চুপ সব! হুজুর ঝিমান!
পাখা কর, ডাক নিমাইএ”

সাহেব কহেন, “ঝিমাইনি, কই
এই ত জেগেই রয়েছি!”
মোসাহেব বলে, “হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা
আগেই সবারে কয়েছি!”

সাহেব কহেন, “জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত
হনুমান আর অপদেব!”
“হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা?”
প্রণামিয়া কয় মোসাহেব।।

সমাপ্ত