Thursday, July 26, 2012

সর্পভুক

লেখকঃ সুব্রত মণ্ডল
এটা বিপ্লবের জায়গা। দিঘীর কোণে বসা ক্লান্ত পথিক নাকি বন্দুকের আওয়াজ পায়। বাতাসে বুঝি বারুদের গন্ধ মেলে। তিন বিপ্লবীর বোমার বারুদ। এলাকায় এলেই সংগ্রামের ছোঁয়া লাগে। চরিত্র পাল্টে যায়। ট্রাম পোড়ে , বাস পোড়ে, মেহনতী মানুষের চিৎকারে দীঘির লাল জলে ঢেউও ওঠে।
এ পাড়ার বাসিন্দারা শুধু দেখে যায়। বাসিন্দা মানে রাতদিনের বাসিন্দা। সংখ্যায় যে কত, এরা নিজেরাও জানে না। বিচিত্র সব পেশা- সাপখেলা, বানচালা, চা বেচা, পাতা বেচা, ঠেলা টানা, ক্ষুদ ভাজা আরও সব নানা ধান্দা। ব্যস্ত এই মানুষগুলো কিন্তু বিপ্লবের ঝাঁজ ঝাঁপিয়ে চলে। এড়িয়ে চলে চিৎকার চেঁচামেচি, জিন্দাবাজ, মুর্দাবাদ। তখন ওদের ধান্দার সময়। পেটের ধান্দা। পতিরাম ওদেরই একজন। ওর পদবী নেই। বয়স একটা আছে, তবে বলা শক্ত কারণ ও নিজেও জানে না। পাকা ঢাঁড়সের মতো চিমড়ে বুক, গোল মাথা- যেন মেরামত করা ফাটা ফুটি, দেখার মধ্যে শুধু চোখ দপ দপ করে। গায়ের রঙ কামলা রুগীদের মতো হলদে।

ওরা দীঘির চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পেল্লায় পেল্লায় পাইপের মস্ত হাঁ, ট্রাম কোম্পানির টিনের ছাঁউনি, বারোয়ারী পেচ্ছাবখানার একচিলতে ছাদ। যারা ঝুনো মাল তারা রাতের বেলা এদিকে ওদিক বড় বড় বাড়িতে সেঁধিয়ে যায়। খাওয়া, দাওয়া, শোয়া, প্রাকৃতিক কাজকম্মো ওখানেই সারে। পতি হাঁপাতে হাঁপাতে খিস্তি দেয়। পাকা ছাদের বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে বলে- যে দিন হুড়কো দেবে সেদিন বুঝবি, কোটা বাড়ির আরাম বেরিয়ে যাবে, ছিটকিনি যাবে। আসলে সে হিংসায় বলে। শীতের ঠক ঠকে রাতে দীঘির ঠান্ডা হাওয়া পাইপের ফোকর বেয়ে যাওয়া আসা করে। পতি হুঁ হুঁ করে কাঁপে। মান্তুকে জড়িয়ে নিষ্ফল প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়। হেরে যাওয়া অপমানে খেউড় ছোটায়, আছোলা বাঁশ দেবে, বুঝবি, কোটাবাড়ির কি আরাম।

পতি আমাদের গুনিন, সাপখেগো বাজীকর। সে ভেলকি দেখায়। গির্জার সামনে, লালবাড়ির পেছনে, ব্যাঙ্কের ধারে, ভেলপুরী দোকানের পাশে। ঘড়ির কাঁটা তখন নয় থেকে দশের মাঝামাঝি জায়গায় আটকে, শয়ে শয়ে বাস, মিনি আর ট্রামের দল সাপের মত এঁকে বেঁকে এলাকায় ঢুকে পড়ে। উগরে দেয় দঙ্গল দঙ্গল দুপেয়ে জীব। খানাখন্দ ক্ষত বিক্ষত ফুটপাতের উঁচু উঁচু ঢিলা, কাদাভরা গর্ত, পেচ্ছাবের স্রোত, বাবুরা সাবধানে পেরিয়ে যায়। অদ্ভুত কৌশলে। বিরক্তের পঞ্চমে স্বর তুলে বলে হবে না, কিচ্ছু হবে না, মিলিটারি রুল চাই ধরো আর কেলাও। ভুরু চাঁচা, খাটো জামার বিবিরা সাবধানে এগিয়ে চলে। গোড়ালির উপর দু এক আঙুল জায়গা ময়লা সায়ার শাসন ভুলে উঁকিঝুঁকি মারে চলার তালে তালে। বাবুরা গতি খাটো করে আড়চোখ চায়, বলে- ভোট ফটে কিছু হবে না, চাবুক চাই, ধরো আর মারো।

পতিরাম চেঁচায়- বাবুরা বিবিরা, এদিকে দ্যাখেন। বিষধর সাপ। আট হাত জাত সাপ। কামড়ে হাতীর মরণ। পোষা সাপ, মোর কথায় ওঠে, মোর কথায় বসে। মায়ের কিপায় দুধ খায়। আমার বেটা বটে।

কজন অফিস যাত্রী থমকে দাঁড়ায়। লোকটি হাড় জিরজিরে চেহারা, গলায় জোড়ানো মস্ত সাপ, মাথাটা এদিক ওদিক দোলে। সামনে পুরনো প্লাস্টিকের বালতি। তাতে জল। আর একটা মগ। আয়জন মন্দ নয়। ভুরু কুঁচকে তারা দোনামনা করে। আগামী ক মিনিটের দেওয়া নেওয়ার একটা চুপচাপ হিসেব নিকেশ করে নেয়। লাভের ব্যাপারীরা দাঁড়িয়ে যায় আর বাকিরা তড়িঘড়ি চলতে শুরু করে।

পতি আশপাশ জরীপ করে। ছ, সাতজন লোক। মানে আট আনা করে দিলে পাঁচ টাকার কারবার। আরও বক্তিমের দরকার।দ্যাখেন বাবুরা মায়েরা কৃপায় আমি বিষহরি। বড় বড় সর্প আহার করি, গপ গপ করে খাই, আবার তেনার দয়ায় উগরে দিই। সবাই মা জননীর লীলে খেলা, কিপা বটে। এ খেলা মারণ খেলা, ঝাপান খেলা, বিষহরি। দ্যাখেন বাবুরা, বিবিরা, সাপগেলা দ্যাখেন, কোনও টিকিট নাই, খুশি হলে দিবেন, বা না দিবেন, কোনও দাবী নাই।

পতির চোখ চরকির মত ঘরে। বেশ কিছু মানুষজন, সব ঘন ঘন বাড়ি দেখে। বাবুদের অফিসের তাড়া। আর দেরি করলে দু'চারজন ধাঁ হবে। সব হিসেবি বাবু।

ও আকাশের দিকে হাতজোড় করে। পেন্নাম ঠোকে মা মনষাকে। বিড়বিড় করে বশীকরণ আওড়ায়। বড় গুনিনকে সেলাম করে। জল খেতে শুরু করে এক গেলাস, দু গেলাস, পরপর। বালতিটা উল্টে শেষ ক ফোঁটা জল চুকচুক করে টেনে নেয়। সাপটারে হাত বুলোয়- আয় বাবা কাছে আয়, গব্বে আয়। ওটার মুণ্ডু নিয়ে মুখে ঢোকায়, আস্তে আস্তে। ধীর গতিতে সরিসৃপটা এগিয়ে চলে, যেন কথা শোনে। একসময় ল্যাজের শেষভাগ দু'চারবার লটগট করে মিলিয়ে যায় মুখের মধ্যে। পতি হাসে, তৃপ্তির হাসি। ভাঙা চেয়ালে শুকনো চামড়ার খুশির কটা রেখা ফুটে উঠে চকিতে মিলিয়ে যায়। একদম খাঁটি হাসি। বাবু বিবিদের সেলাম ঠোকে। ডাইনে, বাঁয়ে, চারদিকে।

তখন ফিসিফিস আওয়াজ। যেন কোনও ঘটনা ঘটে যেত। না ঘটাই উচিৎ। এ ঘটনার কোনও যুক্তি নেই, মানে নেই, একটা নির্গুণ ফালতু ব্যাপার। এটা সহজে হজম করা শক্ত। ভরপেট ভাত খাওয়া বাবু বিবিদের গা গুলিয়ে ওঠে। দিনের আরম্ভে এরকম একটা বদ ব্যাপারে সাক্ষী থাকার বিরক্তি তাদের খোঁচা দেয়। এটা না দেখলেই হত, অফিসের দেরি, মনের ওপর ফালতু উকো ঘষা।

এটা শালা কি হল?

একটা ভদ্দরলোকের কাজ? সাতসকালে সাপ খাওয়া!

বললাম তো ইন্ডিয়ার কিসসু হবে না।

মহিলারা উসখুস করে। চোখে ভয় মেশানো বিরক্তি। চুড়িদার বিবি সঙ্গিনীকে আস্তে আস্তে বলে, এই যাইরে, গাটা কেমন করছে। সঙ্গিনী নীরব চোখে সহানুভূতি জানায়। দুই মেমসাহেব, লাল লাল রং, গায়ে নীল গেঞ্জি, আর জিনসের প্যান্ট, গলায় ঝোলানো ক্যামেরা। যেন জিনে পাওয়া হুরি। এহেন তাজ্জব কাণ্ড তারা তামাম দুনিয়ায় দেখেনি। চটপটির আওয়াজের মতো সার্টারে বোতাম টেপে। ভিড়ের ঠেলা কনুইয়ে গুঁতো, চিমটির জ্বালা কিছুই তাদের মনোযোগ বিঘ্ন ঘটায় না।

পরিপাটি চুলের ধুতি পরা বাবু অসহিষ্ণু গলায় বলে, এরপর কী হবে গো? সাপটার কী হবে?

হাঁ হাঁ কি হবে? জনতা তাকে সমর্থন করে। ঘটনার শেষ জানার অপেক্ষায় তারা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে।

পতির হাসি পায়। সে এ মুহূর্তটা বেশ মৌজ করে উপভোগ করে।

আর ক দণ্ড পরেই বাবুরা সট সট করে কেটে পড়বে। দু-চারজন পয়সা ছুড়ে দেবে তাচ্ছিল্যভরে। আর কজন দার্শনিকদের ভঙ্গিতে হাঁটা দেবে, যেন জগৎ সংসারে সবই মায়া। এ শুধু মায়ারই খেলা, কেন এতে জড়িয়ে পড়া?

তার ভেতর হালকা সুখানুভূতি কাজ করে, দ্যাকো তোমাদের আটকে রেকেচি, অপিসে সাহেবের রাঙা চোকও তোমাদের টানতে পারে না। এ হল বেটার ছুঁচো গেলা, গিলতেও পারে না, উগরাতেও পারে না।

সে বাবুদের হাড়ে হাড়ে চেনে। তাই এই নষ্টামি বুদ্ধি। তবু আজ খুশির দিন। দু মেমসাহেব আছে। ওরা ভালো টাকা দেয়, পাঁচ, দশ, এমনকী মায়ের কিপা হলে বড় লোটও দিতে পারে।

বলি হচ্ছেটা কী? তাড়াতাড়ি বার করো, সাপটা মরে যাবে যে। বাবুদের ধৈর্যের সীমা ভেঙে যায়।

কীরকম ইনডিসিপ্লিন্ড দেখেছেন? অফিস টাইমে খেলা দেখায়। এক আধুনিকা উত্তপ্ত আবহাওয়ার দেশলাই মারে।

সবাই চিৎকার করে, হাঁ হাঁ তাড়াতাড়ি করো। হজম করো, না হয় বার করো।

আর দেরি করা উচিৎ নয়। এর বেশি হলে বেশির ভাগ বাবুই কেটে পড়বে। ওনাদের বিনি পয়সার বায়োস্কোপই বেশি পছন্দ। সে মা মনষারে স্মরণ করে মাগো বেটাকে টান মা। সামনে ঝুঁকে দু হাতে পেটে মোচড় দেয়। বমন ধৌতির বহু দিনের অভ্যাস। পেটের ভেতর শোরগোল ওঠে। অবাগা জীবটা নড়ে চড়ে, যেন ঘুম থেকে উঠেইপাশ উপাশ করে। বেটার কোনও কাম নেই, খায় দায় আর কোটরে ঢোকে। সুখের জীবন!

আর পতির ভাগ্যটা দ্যাকো? মানুষে কত কাম, মাল বেচা, মাল টানা, শান দেওয়া, ঠেলা টানা আর তার? সাপ খাওয়া, সে সর্পভুক। সে উগরে দেয়। জলের তোড় ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে। সাপের মাথা, সাপের পেট, শেষে লিকপিক করে চাবুকের শেষ আছাড় মারে ওটার লেজ।

বাবুরা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে। যেন ম্যানহোলের ঢাকা খুলে বেরিয়ে আসে একরাশ পচা হাওয়া। মরণ নেই রক্তপাত নেই। সুন্দর উপসংহার। শুধু আছে ইচ্ছাপূরণের একটা বিরাট ঢেঁকুর।

শালা ঢোঁড়া সাপ। অফিস টাইমে খেলা দেখায়, ভাবে আমরা বুঝি ধরতে পারব না। সাপ খাই না বলে কি সাপ চিনি না। পাকা জুলফির যুবক যেতে যেতে মন্তব্য করে। ঢোঁড়া নয়গো বোড়া। সাক্ষাৎ চন্দ্রবোড়া। একেবারে জাত সাপ। পতি প্রতিবাদ করে। সে বাবুদের সর্পজ্ঞান জানে। বাবুরা কালসাপকে ধরে বলে গোসাপ। কানড়কে বলে করাত।

খাটো চুলের বিবি উসখুস করে। ব্যাপারটা সে কিছুতেই মানতে পারে না- রাবিশ। ইমিটেশন। লোক ঠকাবার জায়গা পায়নি? জ্যান্ত সাপ কেউ খেতে পারে। ইন্টেস্টাইন পাংচার হয়ে যাবে না? সে শূন্যে জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দেয়।

পতি মেয়েটির সব কথার মানে না বুঝলেও বুঝতে পারে একটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠেছে। সে আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ে ইমিটেশন নয় মা, নাগদমন। আমরা নাগেরে বশ করি।

বেশ করো, মেয়েটি তাড়াতাড়ি হাঁটা দেয়। সে পয়সা গোনে। টাকা, আদুলি, কুঁচোকাঁচা মিলিয়ে বারো টাকা আশি পয়সা। বউনি মন্দ নয়। মেমসাহেবরাই দশ টাকা দিয়েছে। তার পেট টিপে টিপে দেখেছে। ডজনখানেক ছবি তুলেছে।

এরকম ভাগ্যি রোজ যায় না। হর রোজ দু'চার টাকার কারবার। দুটো পেট। পেট নয়তো গহ্বর। যা দাও গরগর করে ঢুকে যায়। মাগিটাই আধ সের চালের ভাত খায়।

যেমন ধুমসি গতর, তেমনি ছেনাল হাসি। কোথা থেকে এত হাসি আসে পতি ভেবে পায় না। পাড়ার এত ছেলেমেয়ে, কোনট ওর মতো? তাদের ফুরসত কোথায়? দিনরাত কাম আর কাম। সে গজরায়, হাসিস নারে হাসিস না এত হাসি ভাল না।

হাসব না তো কাঁদব? কিসের দ্যুকে শুনি? খিদের জ্বালায় মোর পেটটা জ্বলে যায়। তোর ছেনালি হাসি আর সয় নারে, সয় না। পতির গোল গোল চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।

কিসের ছেনালি তুই দেকিস রে? সাপ খেয়ে কি খিদে মেটে? বাকড়ের সনসারে মারো ঝাড়ু। গায়ে গতরে খাঁটি, সের চালের ভাত রাঁধি, আর তুই বলিস ছেনাল? মুকে কুট হবে না? মান্তু রাগে গরগর করে।

পতির আজ রাগ বেড়ে যায়। যেন বোশেখ মাসের গনগনে রোদ। বড় তেষ্টা। ঘরে এক ফোঁটা জল নেই। পাড়ার সব কল খারাপ। জলের তরে অফিসে ঢুঁ দিয়েছিল। গোঁফওয়ালা দারোয়ান গেটেই আটকে দেয়। সব রাগ গিয়ে পড়ে মান্তুর ওপর। ওর মিচকে হাসি, ফিচকে চলন আর গতরের দুলকি নাচন মাথায় আগুন দরিয়ে দেয়। অভাবের সনসারে গলার ওই চকমকে গিল্টির হারটা যেন আগুনে কেরোচিন ছেটায়। সে কি অন্ধ? সে কি জানে না, কীসের এত ফুটফুটানি? কীসের এত লবজবানি? পতি রাগে ফেটে পড়ে তুই কি ভাবিস কিছু বুঝিনি? কিছু জানিনি? তোর মতো রাঁড়ের মুকে পেচ্ছাব করে দিই। গতর বেচে লপজবানি করিস। বেরিয়ে যা মোর ঘর থেকে, বেরিয়ে যা। মান্তু টানটান হয়ে বসে। তারপর যৌবনের রেখাগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। যেন প্রলয়ের সন্ধিক্ষণে মহামায়ার প্রিয় সহচরিণী শূল, শেল আর ত্রিশূল হাতে দানব সংহারের প্রস্তুতি নেয়।

পতি ভয় পায়। সে শক্তিতে, বাক্যিতে, কোনও কিছুতেই ওর সমতুল নয়। সে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। হাতজোড় করে বলে মারিসনি মাইরি।

মান্তু লাফিয়ে ওর বুকে চেপে বসে। দু'হাতে সাঁড়াশির চাপ দেয় পতির গলায়- বলবি আর বলবি কখনও? হারামি মিনসে! যার যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। খ্যামতা নেই সাপখেগো ভূত, কলজের জোর নাই। না লাগে ভোগে না লাগে কামে।

পতি হাঁপায়। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। একটা দুমনি অজগর যেন গিলতে সে। ফোঁস ফোঁস আওয়াজ। ছাঁক ছাঁক ঠাণ্ডা। থির চোখের মণি। দেহটারে পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে ওঠে। মটমট আওয়াজ। কানের কাছে হিস হিস করে তুই অনেক অবেলা জীবেরে গিলাছিস এবার তোকে গিলি। সর্পভুক অজগর।

পাইপের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একটা বিরাট চুড়ো। তাতে ফেলাগ। পতপত করে ওড়ে। দুপুর রোদে ওঠা ঝিমিয়ে ন্যাতানি হয়ে যায়। পতি আর দেখতে পায় না। রাশি রাশি হলুদ ফল। উঁচু উঁচু অফিস ঘর, গির্জার মাথা, লাল বাড়ি, সব ঝাপসা হয়ে আসে। অনেক কষ্টে দম নিয়ে বলে মারিস নে মাইরি।

মান্তুর রাগ পড়ে না, আবার ঝাঁকুনি দেয়- বলবি? আর খেউড় কাটবি?

পতি কোনওরকমে দম নেয়- মাইরি না, খ্যামা দে, মোরে খ্যামা দে।

সন্ধেবেলা হাট ভাঙার পালা। দু-এক লাখ লোক দেহের রস নিংড়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় ছিবড়েগুলো। রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বলে। অফিসে আদালতে ঝাড়াই সাফাই চলে। দরজায় তালা পড়ে। দিঘির আয়নায় লাল বাড়ির ছায়া ঝলসে ওঠে আলোর রোশনাইয়ে। পাড়ার নানা মানুষ নানা ধান্দায় বেরিয়ে আসে। পতি শুয়ে থাকে। পেল্লায় পাইপের হাঁ, তাতে ছেঁড়া চটের আবরু। সে শুয়ে শুয়ে তারই ফাঁক দিয়ে আশমানের চাঁদ দেখে। এটা তার নিজস্ব বিলাস। বাগানে অন্ধকারে ট্রাম ঘুরে ঘুরে যায়। টুংটাং আওয়াজ। চাকার ঘড়ঘড়ানিতে তার ঢুলুনি আসে। প্রথমে একটু খিদে পায়। পেটটা জ্বালা করে। তারপর খিদের ভাবটা কেটে যায়। সে চোখ বুজে পড়ে থাকে। মাঝে মধ্যে চমকে ওঠে। হাঁড়িতে ঢুসঢাস, ফোঁসফোঁস শব্দ। খিদে লেগেছে, বেটার খিদে লেগেছে। সে ওতে কান দেয় না। দাঁত ভাঙা ওই বোড়ারে সে থোড়াই কেয়ার করে। সে নাগদমনে মহাগুনিন। কালনাগ, কালসাপ, কেউটে, কানড় নিয়ে খেলা করে। হেলায় গিলে ফেলে চিতি, চিতা, বোড়ার দল। বউটা তারে চিনল না। গুণের খবর রাখল না। নিজেরে নিয়েই ব্যস্ত। কাঁড়ি কাঁড়ি গিলবে আর গতর দোলাবে। আসলে পতির মুখ নেই। সে ভয় পায়। এ অল্প রোজগারে যে সংসার চলে না সে জানে। ভাতের খরচ, পাছার কাপড় আরও টুকিটাকিতে যে কত লাগে সে বোঝে না যে তা নয়। না জানার ভান করে। সত্যি কথা স্বীকার করতে পৌরষে লাগে।

মান্তুর রোজগার তার অজানা নয়। সে জানে ও কী করে কামায়, তবু চুপচাপ থাকে। রাত যত বাড়ে আশপাশ অফিসে ঢুকে পড়ে মান্তু, সায়রা, রাধা। রংমাখা মুখ, চুলে জরির ফিতে, আর কটা মেকি গয়না। দরজায় থাকে চওড়া গোঁফ আর মোটা জুলফির প্রাচীন সব প্রহরী। চটজলদি বাজার। দরদাম, মালের হক সবই ক মিনিটের কারবার। ব্যস্ত বাবু বেসিনে মুখ ধুয়ে ফুরতি ছোটে। বাড়ি ফেরার তাড়া।

সে উঠে বসে। শরীরের চেনা যন্ত্রণাটা ধীরে ধীরে তার ক্ষোভ, দুঃখ, খিদে আরও বিচিত্র সব অনুভূতি গিলে খায়। গায়ে ছুঁচ ফোটার বেদনা। সে যাবে না, কিছুতেই আজ যাবে না। ও বিষের কারবারে তার আর মন নেই। অনেক হয়েছে, অনেক পয়সার ছেরাদ্দি, অনেক গালমন্দ। অভাবের সনসারে এ হাতির খরচ সে আর বইতে পারে না। চুপচাপ মুখ গোঁজা পাছা উঁচু খরগোশের মতো শুয়ে থাকে। চারদিকে বোড়ার দল, ওরে ছোবলায়। কী কষ্ট কী বেদনা! এই আজ শেষ। এই মায়ের মাথার দিব্যি, সতী বেহুলার ছি-চরণের দিব্যি, নাগরাজ গরুড়ের দিব্যি, আজই শেষ। চটপট করে নতুন জামাটা গলিয়ে নেয়। ফাটা বালিশের গোপণ কোণা থেকে বার করে আনে পাঁচ টাকার একটা নোট, বহু কষ্টে জমানো। মান্তুর কাছ থেকে অনেক কৌশলে আড়াল করে রাখা গুপ্তধন।

ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, আচেরে। খাঁদু তার খদ্দের সামলায়। চায়ের দোকান। আড়চোখে পতির দিকে চায়। তার পুরানো খদ্দের। পাতার খদ্দের। সে অদ্ভুত ইশারা করে, যার মনে সে আর পতি জানে। পতি ওকে টাকাটা দিয়ে মন্দিরে বসে।

দোকানের লাগোয়া বজরঙবলীর মন্দির। ফুটপাথে বিরাট অশ্বত্থ গাছ, তারই কোলে চওড়া চাতাল। একদিকে খাঁদু খাঁর দোকান, পেছনে থানা, পাশে আকাশ ছোঁয়া ইমারত। চাতালে বসে কটা খোঁচা দাড়ির লোক, সাদা ধবধবে পটের বিবি, গায়ে পাঞ্জাবি। সামনে দাঁড় করানো লাল রাজদূত, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কড়কড়ে মাড় দেওয়া সাদা পোষাকের সার্জেন্ট। এরা পতির নিজের লোক। এটা নিজের জগৎ। আরামের আশমান। সে উবু হয়ে শ্বাস নেয়। সাদা গুঁড়োর ঝাঁঝ নাক দিয়ে মাথার অসংখ্য নদী নালা বেয়ে সারা শরীরে পিঁপড়ের সুড়সুড়ানি দেয়। সে সুখের আয়নায় মুখ দেখে। ভেসে চলে চাঁদের দেশে। ধুমশো মাগির নাগাল ছাড়িয়ে, চিতি বোড়ার ফোঁসফোঁসানি ফেলে উড়ে চলে। পটের বিবি হেলে দোলে। সুখের হাওয়ার টাল খেয়ে পতিকে আঁকড়ে ধরে। কী সুবাস!

পতির কপাল, কপাল। ঘরে ছানার তাল, আর এটা?

বংশী মাঝি চোখ মটকায়- ডাঁসা মাল।

খাঁদু কখন এসে দাঁড়ায়। হো হো করে হেসে আসর জমিয়ে তোলে, তোরই তো বাজার পতি, লতুন জামা, আর কত লুকুবি, পতি? দু হাতে কামাইছিস নারে? কামা, কামা, ঘরে লকলকি বউ, হাতির গতর, দু হাতে লোট, লোটের ফোয়ারা ছোটে।

বংশীর জীবটা চুকচুক করে দু'বার ভেতর বাইরে করে। ওরকম এটটা মাগ থাকলে আমি ঘর লিতাম, খ্যাংরা পট্টিতে ঘর লিতাম।

রাজদূতের আওয়াজে আসরের গুলতানি ক দণ্ড থেমে যায়, ঘড়ঘড়ে শব্দে জন্তুটা ছোটার আগে দম নেয়। ফুলপরি আঁকড়ে ধরে কোমরের মোটা বেল্ট। বেবুশ লতার মতো এলিয়ে পড়ে চওড়া পিঠে। টুপিটা মাথায় দিয়ে সাহেব বলে কোন মাগিটারে বংশী? লদলদে লম্বুটা না মোটা হাতিটা? একদিন তুলে আন তো, একটু রেওয়াজ করি।

পতির নেশা কেটে যায়। মনে হয় জামাটা ফ্যালফ্যাল করে দিঘির জলে ফেলে দেয়। কদিন আগে মান্তু ওটা কিনে এনে বলে, গায়ে দিয়ো চারদিকে বাবুরা ঘোরাফেরা করে, উদলা গায়ে কি মান থাকে?

ও আস্তে আস্তে সরে আসে। গির্জার বাগানে সাদা থোকা থোকা ফুল। গন্ধে জায়গাটা মাত। নিজের অজান্তে পা আটকে যায়। ক সেকেন্ড অকারণে দাঁড়িয়ে থাকে। পরপর কটা লোহার রেলিং। মাথা ছুরির ফলার মতো খাঁজকাটা। ঘুমিয়ে পড়া জিম্মেদারি নিয়ে ওগুলো সঙিন উঁচিয়ে আছে। কী এক আবেগে সে জামাটা রেলিং-এ ঝুলিয়ে দেয়। দেওয়ালে পেরেক আঁটা মনিষ্যির মতো ওটা দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক যেন কাঁকড়াতাড়ুয়া। নিজের কেরামতিতে পতি ভারী খুশি হয়।

এখন রাত বড় কঠিন। হাড্ডাহাড্ডির লড়াই। ক হাত শোয়ার হক নিয়ে হাতিহাতি, মারামারি আকছার চলে। ঘুরঘুর করে মালটানের দল। পার্কের রেলিং, নর্দমার ঢাকা, রাস্তার আলো সট সট হাপিস হয়। শুকে ভুটের দল ঠেলার মাল তোলে। লোহার বিম, তারের বান্ডিল, কত সব যন্ত্রপাতি। পতির লালস আসে। ওদের দলে বড় আরাম, লোটের হরিপুট। কাজের কোনও কসরত নাই, ভয় নাই। সনসারে দুটো পয়সার বড় দরকার। মাগিটা বাজারে নাম লেকাল- দুটো পয়সারই তরে। ওর মতো একটা অকেজো ফালতুকে নিয়ে আর কদিন চলে? পেট তো চলে না। গব্বের ভেতর সাপের ছানাগুলো ঢুঁ মারে, নাড়ি ফুঁড়ে বাইরে আসতে চায়। সে মহাগুনিন, ফুসমন্তরে ওদের জিইয়ে রাখে।

দিঘির ধারে ফুরফুরে হাওয়া। সে শুয়ে থাকে। পাতার নেশা কখন পগার পার। ওর ঘুম নেই, কতদিন তার হিসেব নেই, কোনও বেদনা নেই, শুকনো চামড়ায় কোনও অনুভূতি নেই। তবু এ হাওয়া যেন তাকে ঘুরেফিরে ঘুমের ছোঁয়া দেয়। সে উলঙ্গ হয়ে যায়। চারদিকে বড় বড় বাড়ি- সারারাত আলো জ্বলে। গাছগাছালিতে জায়গাটা ভর্তি। সরকার থেকে লাগানো। রংবেরঙের ফুল ফোটে আবার ঝরে পড়ে। মাঝেমধ্যে দু-একটা নিশাচর পাখি ডেকে ওঠে। পতি গ্রামের মানুষ, ওদের চেনে। অদ্ভুত আত্মীয়তা বোধ করে। এই রাতটুকুই তার সম্পদ। শান্ত, চুপচাপ, যেন ঝিম মেরে পড়ে থাকা নাগরাজ। একটু খোঁচায় জেগে উঠবে কাল। হিসহিস আওয়াজে শোরগোল তুলবে। চিৎকার, চেঁচামেচি, ঘড়ঘড়, ঢংঢং, ভাঁকভাঁক শব্দে তেতে উঠবে কালকের সকাল। পতি কিন্তু তা চায় না। সে শুধু শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। ঘুম নেই, খিদে নেই, সাপ নেই, সে আর নিজের এ রাজত্ব।

দিঘির চারদিকে সে ঘুরপাক খাই। চোখ দুটো আগুনের ভাটা, কাতা দড়ি বাঁধা। পাঁচ হাতি শ্যাওড়ার পালা। ওরা বলে দানো। সাপখেকো ভূত। বিষের ঝাঁঝে জ্বলে মরে আর ঘুরে বেড়ায়। রশিদ চাচা কোটর হাঁক দেয়, ঘরকে যা পতি, আতের বেলা ঘুরিস না। চারদিকে দানো, খাড়া খাড়া কান, হট কাট যা পায় গিলে খায়। পতি চুপিসাড়ে কোটরে ঢোকে। অন্ধকার কালো একটা গর্ত। চটের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় মান্তুর ঘুমন্ত শরীর। কাপড় এলোমেলো, একরাশ চর্বির তাল, বকরির পাছার মতো দলেদলে। সে দোনামোনা করে।

ভেতরে এস, রাত অনেক। অন্ধকারের ভেতর থেকে খনখনে গলার স্বর ভেসে আসে। সে থমকে দাঁড়ায়। মাগিটা জেগে। ছেনালটা মটকা মেরে শুয়ে। সে ঢুকবে না। কিছুই না। ওই পাইপের অন্নে মুখ দেবে না। আজ স্যাঙাতদের মশকরা বড় লেগেছে। খসখসে চামড়ায় ছড়ে যাওয়া খাঁজে ওরা কাঁটা ফুটিয়েছে। এটা প্রাণভোমরার সেই জায়গা যেখানে ছোট্ট আঘাত নিশ্চিত মরণ। শুধু জায়গাটা জেনে নেওয়া।

ভাত করেছি, খাবে এসো, মান্তুর গলায় ঘুমের ছোঁয়া। পতি দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ যেন তার বল শুষে নেয়। হাজার চেষ্টাতেও এক পা এগোতে পারে না।

মান্তু কুপিটা জ্বালে। সানকিতে যত্ন করে ভাত সাজায়। কলাইয়ের গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে বলে- কচ্ছিলে কী? কখন থেকে জেগে আছি, ভাবি এই বুঝি এলে।

পতি সব ভুলে যায়। তার জ্বালা, যন্ত্রণা, অপমান যেন কর্পূরের মতো উবে যায়। মাগিটার ভেতরে যে কী আছে, সে জানে না, কী ফুলসমন্তরে সে ও সবকিছু ঠাণ্ডা করে দেয় তার জানতে ইচ্ছে করে।

দু গ্রাস ভাত মুখে তুলে আর খেতে ইচ্ছে করে না, ও পাতে হিজিবিজি টানে। মান্তু মন দিয়ে স্বামীকে ঠাওর করে। চোখ ঘোলাটে, হলুদ রং কেটে জবার মতো রাঙা। আঙুল কাঁপে, ফাঁক দিয়ে ভাত ঝরে পড়ে। ঠোঁট দুটো ঝোলা। এসব কিসের লক্ষণ সে জানে। পাতার নেশা। সাক্ষাৎ কালসাপ। মদ নয়, তাড়ি নয় যে উল্টে পড়বে, খেউড় কাটবে, আবার নেশা কাটলে পায়ে এসে পড়বে। বাক্যিটা সোহাগের বান ডাকবে। তাগড়াই তাগরাই মরদ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। পতির পতন তো নিজের চোখে দেখা। অমন জোয়ান লোকটাও হেঁপো রুগির মতো কোঁ কোঁ করে। ভীষণ অভিমান হয়। কত কষ্ট করে গতর বেচে দুটো পয়সা করে আনে শুধু পোড়া পেটটার তরে, নিজেকে নিয়ে অত ভাবে না, রোগা মরদটার জন্য বড় মায়া হয়। কোনও গুণ নাই, শুধু সাপ গেলা, সে শিউরে ওঠে। তার বরাত। নইলে টানা মালের কারবারে কত লাভ। শুকে নিজের লোক। একবার বললেই পতিকে টেনে নেবে। সত্যি বলতে কী মান্তুকে দু'চারবার আভাসও দিয়েছে। শুধু কাজে লেগে যাওয়া। পোড়া কপাল! পতিকে রাজি করানো যা না। ওর নীতিজ্ঞান বড় খরখরে। আভাস দিলেই বলে, এসব কথা তুলিস নাই বড় পাপ, বড় পাপ। ধরলেই ফটক।

মান্তু মুখ ঝামটায়, কীসের ফটক শুনি? ওরা কচ্চে কী করে? কোচর কোচর লোট। এত ভয়টা কীসের?

পতি উদাস ভঙ্গিতে বলে, তুই বুঝবিনি।

আমি বুঝবুনি! মান্তু অবাক হয়।

হ্যাঁ বুঝবুনি, আমি গুনিন, গুরুর কাছে কসম খাওয়া, পাপের পথে যাবুনি, ধম্মপথে চলব।

মান্তু রাগে গরগরে করে পাপটা কি শুনি? সব লোক করচে আর তোর পাপ। ভয় করে বল? সে স্বামীকে তাতাবার চেষ্টা করে।

ভয় আমার নাই, বললাম তো করবুনি, আমাতে এসব পাপ কাজ হবে নাই।

মান্তু খাওয়া ভুলে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে। এরকম অদ্ভুত কথা সে বাপের জন্মেও শোনেনি। তার কাছে পাপপুণ্যের সীমারেখাটা খুবই অস্পষ্ট। বর্ষার রাস্তায় চলতে গিয়ে কাদার ছিঁটে বাঁচানোর মতোই অবাস্তব। বাঁচার পথে সামান্য চাহিদাগুলো এতই প্রবল যে সেটা কোনও নৈতিক রেখা টেনে পাল্লায় মাপামাপি করা বিলাসমাত্র। সে তার দেহ দিয়ে, যৌবন দিয়ে দুটো প্রাণকে কোনওরকমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সেটা খুবই পলকা, হাওয়ার বেগ এলে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। আর লোকটা রামায়ণ আওড়ায়। তার শরীর জ্বালা করে। মনে হয় বারোভাতারি এ গতরে কেরোচিন ঢালে। তখন মিনসে বুঝবে পেটের জ্বালা কি জ্বালা। ধম্মকথার ফুলঝুরি বেরিয়ে যাবে। নেশার পয়সা কোত্থেকে মেলে সে দেখে নেবে।

মান্তু নিজেকে কঠিন করে তৈরি করে, ঠিক আছে মালটানা পাপ তো চুরির পয়সায় নেশা করিস কোন ধম্মে?

চুরি? পতি আকাশ থেকে পড়ে।

চুরি বই তো কী? তুই পাতা নিস নাই? আজ নেশা করিস নাই?

হ্যাঁ করেচি।

পয়সা পেলি কোতায়?

আমার ছিল।

ছিল! ধম্মপুত্তুর যুদিষ্টি! মিথ্যেবাদী, চোর, তোর লাজ নাই! সনসারে পয়সা চুরিতে তোর লজ্জা নাই। হাত খসে পড়বে। মান্তু উপসী কেউটের মতো ফোঁস ফোঁস করে।

পতি কী বলবে ভেবে পায় না। সে নিজের পয়সায় নেশা করে প্রমাণ করা শক্ত। মাঝেমধ্যে মান্তুর পয়সা চুরি করে না তা মিথ্যে কথা নয়। ধরা পড়ে। কিন্তু আজকের ব্যাপার ভিন্ন। এটা তার খাটনির পয়সা। সাপ খাওয়া ফসল। কিন্তু ধোপে টিকবে না। সে চুপ করে থাকে। লাথ খাওয়া লেড়ি কুত্তার মতো কোন খোঁজে। মিনমিন করে বলে, মাইরি বলছি না, এটা আমার পয়সা। মান্তু খ্যাপা কুকুরের মতো চিৎকার করে, তোর বাপের পয়সা। খবরদার বলছি, আমার পয়সায় হাত দিবি না, হাত কেটে দেব।

পতি ভয় পায়। পিছু হটে। কিছু বোঝার আগেই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। দিঘির ধারে বসে। কত রাত সে জানে। সনসারে ঘেন্না! দু মুঠো ভাতের তরে এত খোঁটা। খুদে তাও মাগিটা অদ্দেক খায়। তার খিদেই নেই। নাড়িভুঁড়ি সব উল্টে পাল্টে যায়। খুদে শয়তানগুলো পেটে ঢুকে কী করে দেয়। ভয় হয়। নেহাত অনিচ্ছায় যখন গব্বে ঢোকে শাপ কাটে ওরে সাপখেগো ভূত, এবার তোকে খাব, হাজারে হাজারে ছোবলাব, ঝাঁঝরা করে দেব। পতি হাঁপায়। হাত দিয়ে দেহ অনুভব করে। নিজের আঙুলে আদর করে। শুকনো কাঠ, চেলা কাঠ। কোনও অঙ্গ নেই। সে ভয় পায়। দিঘীর জল থেকে পা তুলে নয়। হাতড়ে হাতড়ে অণ্ডকোষের খোঁজ করে। পায় না। শুকনো গলায় বিড়বিড় করে- কী হল! মোর কী হল?

পতির একটা ভীষণ কিছু করার ইচ্ছা করে। সব অপমান, জ্বালা মুছে দিয়ে যেটা মান্তুর কাছে সম্মানের আসনে বসিয়ে দেবে। ওই শুকে, ভুটের এক আসনে। আন্ডিল আন্ডিল টাকা, চেকনাই শাড়ি, চকমকে গলার হার, খ্যাংরা পট্টিতে একটা ঘর। মান্তু ঘরে থাকবে। রাঁধবে, বাড়বে, ঘর নিকুবে। সে ভীষণ কিছু করে বেড়াবে। সন্ধ্যেবেলা ঘরে এসে সে গইড়ে পড়বে। মান্তু বসাতা আর জল এনে দেবে, এত খেটুনি, এত খেটুনি, কী হবে এত লোট? শরীলটার দিকে লজর দাও, শরীল থাকলে তো লোট।

সে এটা করবেই। কটা শুকনো হাড় দিয়ে ভেলকি দেখাবে। আর ঢোঁড়া নয়, বোড়া নয়, জাত সাপ কেউটে গিলবে। বাবুরা বিবিরা দলে দলে ভিড় করবে। বিচ্চুটা দুলবে, ফুঁসবে। এঁকেবেঁকে তার গলা জড়িয়ে ধরবে। আমি নাগদমন মহাগুনিন। ওর গায়ের সব ফোঁটা চিনি। সাদা পেট, কালো মণি, হলুদপানা মুখ, কুতকুতে চোখ, ফিনফিনে জীব। ও আমারে আদর করে। বড় সুক হয়। জইড়ে, জইড়ে ওপরে ওঠে, কানের কাছে পিরিতির কথা বলে। আর কেউ জানে না। শুধু আমি আর ও। পয়সার ফোয়ারা খুলবে, বাবুরা লোট দেবে। অপিসের তাড়া ভুলে শাবাশ দেবে। বিবিরা গোল গোল চোখে চেয়ে থাকবে। ভয়ে সব পানসেপানা। কথা নেই, চারদিকে যেন ব্যোমভোলা। পাতার নেশায় ব্যোমভোলা। এই তো জীবন, মরদের এই তো জীবন।

পতি মহাসুখে আদর করে। মান্তুকে আদর করে। ওর বিশাল মুখ গুঁজে আদরের কথা বলে। মান্তু গলে যায়। আগুন পোড়া মোমের মতো গলতে থাকে। সে আর কিছু চায় না। মরদের এ আকুতি ওর সব জ্বালা ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়। অন্ধকার কুপির আলোয় অস্পষ্ট কটা দেহরে খায় ও সুর তোলে। এটা তার নিজস্ব, শুধু পতির জন্য রেখে দেওয়া। নেশাখোর মরদটার জন্য তার বড় দুঃখ হয়। বুক কেমন করে। এটারে কী বলে সে জানে না। তবে বোঝে এ ছোঁয়ার স্বাদ আলাদা। দুঃখ, বেদনা, অভাব, রোজগার, খিটিমিটি, এর স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। সে আনমনা ওর বুকের কটা হাড় টিপে টিপে পরখ করে। আস্তে আস্তে বলে- মনে করুনি কিছু। অনেক কুকতা বলেচি। আগের মাতায় মুকের বাঁধন থাকে না।

পতির বড় সুখ। চুপিসাড়ে শুয়ে থাকে। অনেকদিন বাদে তার ঘুম আসে। সত্যিকারের ঘুম।

বাবুরা, বিবিরা, আমি নাগদমন, বিষহরী, সাপেরে খাই, গপগপ করে খাই। কেউটে, কানড়, করাত, পকপক করে খাই। দু'দণ্ড দাঁইড়ে দেকুন। মূল্য নাই, দিবেন বা না দিবেন, কোন দাবী নাই। আটহাতি সাপ। জাত সাপ। গরলে উবুচুবু, ফি ফোঁটায় হাতির মরণ। আমি বিষহরী নাগদমন।

এপাড়ার সর্পভুক। বাবুদের চেনা। সেই প্লাস্টিকের ভাঙা বালতি, ভাঙা মগ, গলায় জড়ানো চেনা সরীসৃপ। না ওটা নতুন। বাবুরা চলতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। সাপটা আজ কেমন হেলে দোলে।

ফণা তুলে সর্পভুকের মাথার ছাতা ধরে। বাবুদের পা আটকে যায়। দু'চার বিবি বাহরি চশমা খুলে এগিয়ে আসে। পতি হিসেব কষে। আজ মোটা টাকার কারবার। বেটা আমার পয়মন্ত। দুধ দেব, কলা দেব, খড়ের চাটাইয়ে শুতে দেব।

বাবুরা উসখুস করে। একজন অসহিষ্ণু গলায় বলে, কীগো এটা কি সেই ঢোঁড়াটা?

ঢোঁড়া কি বাবু? কেউটে! কাল কেউটে!

বলো কী?

দেকবেন? পতি কৌতুক করে।

বাবুর মনে আঘাত লাগে। বলে কী জানি, আজকাল তো সবই নকল। সিনেমায় তো মেয়েরাও সাপ খেলে।

চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

দুর মশাই, সাপ চেনেন না? এত বড় ফণা আর আপনি নকল দেখাচ্ছেন? যান গিয়ে দেখুন আসল না নকল।

চারিদিকে হাসির রোল। বিবিরা হেলেদুলে হুটোপুটি খায়।

পতি খুশি। ভারী খুশি। ওটার মণিতে আদর করে। ছোট্ট চুমি দেয়। ওরে আমার বেটারে গব্বে আয়।

সে জল খায়। শুধু খায় আর খায়। পলকে বালতি সাবাড়।

আয় গব্বে আয়। অন্ধকার কালো গহ্বর। ওম ওম তাপের আদিম এক গুহা। লসিকায় ভরা। ওটা নিশ্চিন্ত গতিতে এগিয়ে চলে তার ঘরে।

পতি সেলাম জানায়। বারবার কোমর ভেঙে ঘাড় দুলিয়ে কুর্নিশ করে। চারদিকে কী আওয়াজ। হাততালির আওয়াজ। জোরে খুব জোরে।

ডাইনে বাঁয়ে দিক গুলিয়ে বৃত্তের সীমারেখা হারিয়ে যায়।

এই পতি চায়। চিরকাল এই চায়।

সে অস্তাদকে স্মরণ করে। ধৌতির ক্রিয়ার পেটে মোচড় দেয়। একটা অচেনা যন্ত্রণার সাড়া মেলে। একদম নতুন। কলসির জলে একটা ঢ্যামনা শিঙি লটপট করে লেজ ঝাপটায়। ঢুঁ মারে, ওলটপালট খায়। পতি উল্টে পড়ে। দু পা মাথায় তুলে আকাশপানে কী যেন ছুঁতে চায়।

বাসের মাথা, গির্জের চুড়ো, রেলিং-এ কাকড়াতাড়ুয়া, দূরে লাল বাড়ির ফেলাগ, সবকিছু ঘুরপাক খেয়ে তার মাথার কাছে জড়ো হয়। সে শুয়ে থাকে। তখন সময় দশটা দশ। হাওয়া হালকা, ডিজেলের গন্ধ। দিঘির জলে ঢেউ নেই। শুধু দূরে হালকা আওয়াজ। সাইরেন বাজিয়ে একটা গাড়ি ঢোকে। এলাকা ঠান্ডা।

সমাপ্ত