Thursday, July 26, 2012

যুদ্ধপর্ব

লেখকঃ সুব্রত মন্ডল
এক
করুণাবাবুকে মেরে ফেলাই ঠিক হল। সবাই প্রায় এক মত। দু-চারজন মৃদু প্রতিবাদের চেষ্টা করে। বিশেষ করে যারা ওঁর ছাত্র ছিল। অবশ্য তাদের প্রতিবাদ জোরালো হবার সুযোগ পায়নি ভয়ে। আমরা দালাল, প্রতিক্রিয়াশীল এ সব শব্দগুলোকে ভীষণ ভয় করতাম। ব্যাপারটার সর্বসম্মত রূপ দেবার চেষ্টা হয়নি যে তা নয়। ভোটাভুটি হয়। আমি মাথা নিচু করে হাত তুলি। মিশ্রজীর গোয়ালে খাটিয়া পেতে বসেছিলাম। জমাট অন্ধকার। জোনাকির আলোয় গরুর চোখগুলো শুধু চকচক করে। জায়গাটা মুক্তাঞ্চল বললে ভুল হয় না। চারিদিকে মাকড়সার জালের মতো কটা পুরানো গুদাম ঘর। কাছাকাছি দুটো লম্বা দৌড়ের রাস্তা। একটা গঙ্গার পাশ দিয়ে সরকারি মালখানায় ঢুকে পড়ে, গেটে লেখা বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ, আর একটা রেল লাইন ধরে যেতে জি টি রোডে থমকে দাঁড়ায়। দেশি মদের মত চরিত্র এ পাড়ার। অল্পতেই ঝাঁঝ। বাতাসে বিষ্ঠার গন্ধ। বোতলের হাল্কা ঝাঁকুনি বুদবুদের মত ফেটে পড়ে, সকালের জলের লাইন। খিস্তি, খেউড়, চেঁচামেচি, বালতির আওয়াজের কনসার্টের যোগ দেয় এক পাল পাকাদাড়ির মিস্তিরি, পলকা মজদুর আর কাঁচুলিতে শাড়ি জড়ানো কটা সস্তা বেশ্যা। শব্দ ব্রহ্ম চারদিকে ভোঁ ভোঁ করে। লরি থেকে মাল খালাসের আওয়াজে পায়ের তলার মাটিতে কাঁপন লাগে। ঝাঁকে ঝাঁকে কুকুরের দমফাটা চিৎকারে কান ঝালাপালা। তবু এটা আমাদের নিশ্চিত আশয়। কবুতরের বুকের মতো নরম আর উষ্ণ।

করুণবাবু ঝুঁকো চেহারা নিয়ে নিজেই এক জিজ্ঞাসার চিহ্ন। ষাটের তোবড়ানো মুখ, চোখে বোতলের কাচ। পৃথিবীর সব ঘটনার ন্যায়-অন্যায়ের একনিষ্ঠ বিচারক। সাত-এর দশকে এ ধরণের লোক মাঝে মধ্যে মিলত। বোকা মাস্টার, ভীতু কেরানি, ধুতি পরা ডাক্তার সব পাড়াতেই দু একজন উঁকি ঝুঁকি দিত। কিন্তু এটাই শেষ দশক। তারপর ডোডো পাখি। ফুটে আমি আর দেবু। চেয়ারম্যানের নামে ধবনি দিয়ে মূর্তি ভাঙছিলাম।

জেলা অফিসের সামনে ছোট ফুল বাগিচা। মাঝে পলেস্তারাহীন পিলারের উপর খর্বাকৃতি বঙ্গ সন্তানের মূর্তি। সুবিশাল কপাল, গায়ে চাদর, গলায় শুকনো মালা। ফুটে মাথায় হাতুড়ি চালায়।

কোথা থেকে ভোজবাড়ির মতো করুণাবাবুর উদয়। উনি গলার শিরা ফুলিয়ে ছাতি বাড়িয়ে তেড়ে এলেন। জায়গা দ্রুত ফাঁকা হয়ে যায়। কালেক্টার অফিসের জানালার ফাঁক দিয়ে কটা কৌতুহোলী মুখ-বিনে পয়সার সার্কাস।

ফুটে এক ধাক্কায় করুণাবাবুকে সরিয়ে দিয়ে পাইপগান তাক করে। ওর একটা চোখ পাথরের। সব সময় অর্ধেকটা বেরিয়ে থাকে। আর একটা স্থির, ঠিক মরা ভেটকির চোখের মতো। আমি পাইপটা চেপে ধরে বলি-মারিস না মাইরি।

ও জ্যান্ত চোখটা নাচিয়ে বলে-শালা দালাল, বড়লোকের দালাল। একদম জালি মাল।

-মাইরি বলছি, না। আমার স্কুলের মাস্টার মশাই, ছাপোষা লোক। পাইপটা হাতের তালুতে আটকে রাখি।

ততক্ষণে করুণবাবু নিজেকে সামলে নেন। চশমাটা মাটি থেকে তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসেন।

-বাবা অভিষেক না? ভাল, তা ভাল। এটা কি ন্যায্য কাজ? তুমি এর কাছে ঋণী, তোমার বাপ-ঠাকুরদা ঋণী। স্যারের হাতে পরম বিস্ময়ে ধরা থাকে আমার দুটো হাত।

দেবু এগিয়ে আসে। স্যারের ডান হাতটা সাঁড়াশির মত চেপে ধরে বলে-লেকচার দেবেন না, আমরা লেখাপড়া জানি। মনে রাখবেন, আপনাদের মতো মাস্টারই আমাদের তৈরি করেছে। উত্তেজনায় ওর মুখ রাঙা হয়ে ওঠে।

কথাটা মিথ্যা নয়। ও ছিল বিশুদ্ধ গণিতে ইউ জি সি স্কলার। স্কুলের শেষ পরীক্ষাবৃত্তি প্রাপকদের একজন। একদম ননী থেকে তোলা ননী। তবু আমরা লেখাপড়া জানি কথাটা কানে খচ করে লাগে। কোথায় যেন একটু বেদনার সুর, একটু হতাশার ছোঁয়া।

দেবু স্যারকে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, অস্বীকার করেন?

-না বাবা অস্বীকার করি না, দায়িত্ব আমি এড়াই না। কিন্তু তুমি যে ভাষায় কথা বলছ, যে দায়িত্ববোধ তুমি লেখাপড়া করে পেয়েছ-তার কিছুটা তো এঁরই দেওয়া।

ফুটে ফিস ফিস করে-শালা জ্ঞান পাপী, দিই উড়িয়ে।

আমি ফুটের হাত চেপে ধরি। বলি, স্যার, আপনি বোধহয় আমাদের ছাত্র ভেবেছেন।

এ উপদেশ গত একশো বছর ধরে কত লক্ষ ছাত্র শুনেছে? কি লাভ হয়েছে বলুন? ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন। ভাল করে চোখ মেলে চান। অনেক কিছু জানার আছে।

ফুটে চোখের নিমেষে আমার হাতটা সরিয়ে দেয়। গুলি করে। হাতের ধাক্কায় গুলি নিশানা হারিয়ে বাগানের রেলিঙে লাগে। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি ফুটের উপর- মারিস না, স্যারের পাঁচ মেয়ে। ছোটটা মুন্নি। একটারও বিয়ে হয়নি। মরে গেলে ঘোলাডাঙায় লাইন দেবে। পাইপটা তলপেটে চেপে ধরি।

ফুটের সাথে দেবুর দৃষ্টি বিনিময় হয়।

-ওরে শালা লাভার। দেবুর চোখে একরাশ ঘৃণা।

ফুটে আমার কলার চেপে ধরে। পাইপটা গলায় ঠেকায়। যেন পোষা কুকুরের জিভের আদর। ভীষণ ঠান্ডা আর নরম। ওর জ্যান্ত চোখের হলুদ মণিটা থির থির করে কাঁপে। মায়ের মুখ, মুন্নির মুখ- ঘন এলাচির গন্ধ পাই। কী ভীষণ যে বাঁচার ইচ্ছা জাগে। আমায় মারিস না ভাই।

-ফুটে পুলিশ। দেবু চাকিতে পাইপের মুখটা সরিয়ে দেয়। চোখ চাই। কালেক্টার অফিসের জানালাগুলোয় ঝটপট আওয়াজ। দূরে একটা কালো গাড়ি। বুক ভরে নিশ্বাস নিই।

পরের দিন আমাকে তপেনদার কাছে যেতে হল। তপেনদা খাটিয়া থেকে উঠে দাঁড়ান। উনি আমাদের তাত্ত্বিক নেতা। এক সময়ের জীব রসায়নেরও সেরা ছাত্র। ওঁর ত্যাগ সবসময়েই আমাদের প্রেরণা দেয়। পোড় খাওয়া সংগ্রামী। বিড়িতে লম্বা টান দেন। মুখে সযত্নে আড়াল করা যন্ত্রণার ছাপ। ঝকঝকে চোখের কোণে এক চিলতে বেদনার আঁচড়-অনেক কষ্টে লুকিয়ে রাখা। এ যন্ত্রণাময় মুখ আমি আগেই দেখেছি, ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে সার্কাসে। ক্লাউনের মুখ। চোখটাও আমার চেনা। মা যখন ছোটনকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এলেন, দু-এক দিন পরেই হাজির হল তিনটে হিজড়ে। ঢোলক নিয়ে কত নাচনকোদন। বাবা পঞ্চাশ টাকা দিলেন। ওরা তখন হাসছিল। আমি ওদের চোখ দেখেছিলাম। সেই এক চোখ।

দু'বার গলা খাঁকারি দিয়ে তপেনদা বলতে শুরু করেন ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় করুণাবাবু একজন দালাল। ধনিক শ্রেণীর। অভিষেক তাকে বাঁচিয়ে পার্টি-বিরোধী কাজ করেছে। আমরা আরো খোঁজ নিয়েছি, ওঁর ছোটমেয়ের সঙ্গে অভিষেকের ভালবাসা ছিল বা আছে। ও নিজের স্বার্থকে পার্টি আদর্শের ওপরে স্থান দিয়েছে। আমি উপস্থিত বিপ্লবী বন্ধুদের অনুরোধ জানাই তারা তাদের সুচিন্তিত মতামত জানান। তপেনদা আমার চোখ এড়িয়ে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নেন।

হঠাৎই আমার মুন্নির কথা মনে পড়ে। সরোজিনী বিদ্যামন্দিরের ছাত্রী, পনেরোর এই কিশোরী আমার প্রেমিকা। তখন রঙমশাল ছিল আমার প্রিয় বাজি। আমার কল্পনার বুদবুদগুলো সহজে ফাটত না, রঙিন বেলুন হয়ে ঘুরে বেড়াত। আমি গেঞ্জি ছাড়া জামা পরতাম। অস্বীকার করতাম। অস্বীকার করতাম সব কিছু। স্যারের বাড়ি অকারণে বই আনতে যেতুম। মুন্নি অঙ্কের খাতা নিয়ে হাজির হত। দু'একটা অঙ্ক করেই একমনে আঙুলে বিনুনি পেঁচাত। বলত, অভিদা, বাবা বলছিলেন, তুমি নাকি ইলেক্ট্রনিক্স পড়বে। আচ্ছা ইলেক্ট্রনিক্সে নাকি খুব অঙ্ক কষতে হয়? তারপর নিজের মনেই বলত- তোমার তো অঙ্কে খুব মাথা, বাবা রোজই বলেন।

মনে মনে খুশি হই। বলি- এই আর কি। মুন্নি উঠে জানলার পর্দাটা সরিয়ে দেয়। বাইরে কনকচাঁপার মস্ত গাছ। বড়দির লাগান। ও একমনে চেয়ে থাকে।

-তুমি কী পড়বে। আমি জিজ্ঞাসা করি।

-আমি চাকরি করব। উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দেয়।

-কেন? বলেছিলে না ইতিহাসে অনার্স পড়বে? তাছাড়া চাকরি এত সোজা নাকি?

মুন্নি ম্লান হাসে। জবাব দেয়, বাবাদের স্কুলের সেক্রেটারির অনেক হাত। বলেছে দুধের ডিপোয় চাকরি করে দেবে। বাবা আর চালাতে পারেন না। তাছাড়া সন্তান হিসেবে আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে।

এ মুহূর্তটা আমার কাছে সবচেয়ে করুণ। আমি সাহসী বীরের মত ওকে অভয় দিতে পারি না, অথচ বয়ঃসন্ধির উন্মত্ততা আমার মধ্যে সবসময়েই আমাকে নাড়িয়ে দেয়। প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে মিথ্যে আশ্বাস দিই, এত ভেঙে পড়ছ কেন? আমি তো আছিই।

মুন্নি মিষ্টি হাসে। এ হাসি নিষ্ফল প্রতিশ্রুতির প্রতিক্রিয়া, না আমার ভালবাসার স্বীকৃতি তা ঈশ্বরই জানেন। ও যেন আমায় পুত্রস্নেহে সান্ত্বনা দেয়- অভিদা জানো, আমার ছেলেবেলা থেকে না চাকরির ইচ্ছা, বড় পিসির মতো। পিসি কত টাকা মাইনে পায়। বিনে পয়সায় টিফিন।

অন্ধকারে তপেনদার বিড়ির আগুন লাল সিগনালের মতো দপ দপ করে। উনি শেষ টান দেন। ছোট ছোট ধোঁয়ার মালা আমাদের নাক বরাবর ঘোরাঘুরি করে। উনি ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন।

বিপ্লবী বন্ধুদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করুণাবাবুকে খতম করা হোক। অভিষেক যোগ্য সংগঠক। নিষ্ঠাবান কর্মী। এই তার প্রথম অপরাধ। বয়স তার নিষ্ঠার কথা মনে রেখে ওকে ক্ষমা করা হল। বিপ্লবী বন্ধুদের ইচ্ছা, অভিষেক এ কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিক।

ওয়াগান থেকে মাল খালাসের আওয়াজ পাই। তলার মাটিতে কাঁপন দেয়। ক'দিন ধরে মায়ের কথা মনে পড়ে। ভাবি একবার দেখা করে আসি। দেখা আর হয় না। আমার অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে মায়ের কথা বড় মনে পড়ে। শ্মশানে যখন শবদাহ দেখি, পোড়া মাংস ধুনো আর কর্পূর সেন্টের গন্ধ, কেন জানি না মায়ের কথা মনে পড়ে। এ অনুভূতি আমার অনেকবার হয়েছে। স্টেশনে কাউকে তুলে দিতে এসে বা হাসপাতালে ও.টির পাশ দিয়ে যেতে যেতে। ঘষা কাচের ওদিক থেকে ওষুধের গন্ধ আর আবছা আলো, জীবন কিংবা মৃত্যুর খবর বয়ে আনে, আমি মাকে দেখি।

এখন বাড়ি যাওয়া বারণ। পুলিশের কড়া নজর বাড়ির উপর। রাতে প্রতিরোধ বাহিনী পাড়া পাহারা দেয়। দু'দিন আগে ওরা তিনজন বিপ্লবীকে ঠেঙিয়ে মেরেছে। রক্তের বদলে রক্ত। গ্লাডিয়েটারদের লড়াই চলেছে। খুঁচিয়ে মারার প্রতিযোগিতা। সব দেহাংশ আমার মুখস্ত। পরেশের মাথায় পাথরের আঘাত। তপনের তলপেটে গুলি। অমিতাভের অণ্ডকোষ ছিন্ন। মানুষের মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ- অবশ্য এখনও সে বেঁচে আছে। বেশ বুঝতে পারি যন্ত্রণা আর ঘৃণার চেকভালব খুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তবু মানুষের সঙ্গে দূরত্ব? এ বিদ্বেষ? ঘৃণা? এখন দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে। যৌবনের উচ্ছলতায় অকালে ভাটা নামে।

তপেনদা একমাথা রুক্ষ চুলে সরু সরু আঙুল চালিয়ে চুলগুলো ঠিক করেন। দু'হাতে পাঞ্জাবির আস্তিন গুটিয়ে আজকের জমায়েতে এই প্রথম আমার দিকে তাকান।

-অভিষেক! প্রয়োজনীয় সাহায্য তুমি ফুটের কাছে পাবে। ও একশনের অভিজ্ঞ কর্মী। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও তোমার পাশে থাকবে। তোমাদের মিশন সফল হোক।

একপাল কুকুরের চিৎকার শুনি। যেন নরকে তেলের কড়াই-এ ক'টা হতভাগার শেষ আর্তনাদ। মুখে লালা কাটে। টক টক স্বাদ পাই- বোমির।

মিশ্রজীর বউ ছুটতে ছুটতে এসে খবর দেয়, বাবু পুলিশ। জলদি ভাগ জাইয়ে। অন্ধকারে মিশে যাই। সবাই।

দুই
বহুদিন বাদে মাকে চিঠি লিখি। মুন্নির নামে পোষ্ট করি। বাড়ির ঠিকানা দিলে পুলিশের হাতে পড়ার সম্ভাবনা।

মাগো, তোমায় দেখিনি, কতকাল। আজকাল তোমার কথা প্রাই মনে হয়। তখনই ভাবি তোমার ইচ্ছা আর পূরণ হল না। আমায় ক্ষমা করো। ছোটনকে তুমি ইলেক্ট্রনিক্স পড়িও। আমার সব বই সিঁড়ির ঘরে বস্তায় বাঁধা আছে। যত্ন করে রেখে দিও। আর তো ক'টি বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ওর দিকে একটু নজর রাখবে। বাইরে যেন বেশি মন না দেয়। ভীষণ চঞ্চল-ঠিক আমার মতো। চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ও নির্ভয়ে পড়বে। আশীর্বাদ করো মা- আমি যেন তোমার কাছে ফিরে আসি। বারবার বড় দেখতে ইচ্ছে করে।

চিঠিটা লিখে নিজেকে ভীষণ হাল্কা লাগে। জেটিতে পা ঝুলিয়ে বসে থাকি। খড় বোঝাই নৌকাগুলি যেন ডুবুডুবু করেও ডোবে না। দু-একটা ঢিল ছুঁড়ে মারি ওদের নিজের খেয়ালে।

ফুটে আমাকে ক'দিন ধরে আমাকে তালিম দেয়। হত্যার তালিম। সংহরণ তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, ঘাতকের মনস্তত্ত্ব। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভৌগলিক অবস্থান। মগজ, মুখবিবর, রসনা, গলনালি, পাকাশয়, মলাশয়, শ্রেণী, উপস্থ ইত্যাদির নিখুঁত বর্ণনা। পেশাদারী ভঙ্গিতে অস্ত্র শিক্ষা দেয়।

-শিকারের দিকে তাকাবি না, দুরত্ব রাখবি দু থেকে পাঁচ ফুট। এর বেশি হলে ফসকে যেতে পারে।

-কেন? বেকার প্রশ্ন করি।

-কারণ পাইপ গানের নিশানার কোনও ইন্ডিকেটর নেই। ও তৃপ্ত অধ্যাপকের ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, এর সবটাই তৈরি করেছি নিজেদের কারখানায়। কারিগররা আরো উন্নত করার চেষ্টা করছে। হয়ত একদিন হবে, সেদিন তুমি আমি থাকব না। সুফল ভোগ করবে তোমার-আমার ভবিশ্যৎ প্রজন্ম। গা গুলিয়ে ওঠে। সুফল ভোগ করবে ভবিশ্যৎ প্রজন্ম! হয়ত তাই।

ক মিলিমিটার ছেঁদার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ক্ষমতার উৎস। সীতে রঙের বর্তুলাকার যন্ত্রটি আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। ও সন্তান স্নেহে পাইপের গায়ে হাত বুলায়।জ্যান্ত চোখে মমতার ঝিলিক দেখি। ওকে মাঝে মাঝে সিদ্ধপুরুষ মনে হয়। যেন উপনিষদের সেই বস্তুর সন্ধান পেয়েছে, যা পেলে সব পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে ও পারফেকশানিস্ট। কোনও আপস-মীমাংসায় রাজি নয়। কোনদিন হাসতে দেখি না, কাঁদতে দেখতে না। প্লাস্টার অফ প্যারিসের মুখ। নির্লিপ্ত অভিব্যক্ত। শুধু জ্যাত চোখটা সময় বিশেষে নেচে ওঠে। মৃগয়ার সময়।

-ওই কুকুরটা দেখ। ফুটে বলে।

হাত দশ দূরে রেল লাইনের স্লিপারে ঠেস দিয়ে নিরীহ জীবটা ঘুমোচ্ছে। ঝিমধরা দুপুরে নিশ্চিন্ত আরামে। বোধহয় গর্ভবতী। পরিপুষ্ট বুকে পর পর ক'টা স্তনবৃন্ত। স্ফীত, বুলেটের নাকের মতো ছুঁচলো।

-ধর ওইটা তোর লক্ষ্য। কোথায় আঘাত করবি? মাথা, বুক না পেট?

সংশয় বেড়েই চলে। যে কোনও জায়গায় আঘাত করলেই ও মরবে। তবু অজ্ঞতার ভান করি। বলি- মাথা?

ফুটের জ্যান্ত চোখ নেচে ওঠে। বলে-মাথা আমার প্রিয় জায়গা। লাগাতে পারলেই শিকার কাত। তবে অসুবিধেও আছে।

-কি করবে?

ফসকে গেলে ও সাবধান হয়ে যাবে। চিৎকার করবে।

-তবে?

-স্যারকে তুই বুকেই টার্গেট কর। নতুন শিকারীর পক্ষে বুকিই ভাল। যদি না মরে আমি পাশ থেকে ভোজালি চালাব গলায়।

আমাদের কথাবার্তায় কুকুরটার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ পিটপিট করে। বোধহয় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। হেলে দুলে লেজ নাড়তে নাড়তে গঙ্গার দিকে হাঁটা দেয়।

ওর অপসৃয়মাণ শরীরের দিকে তাকিয়ে ফুটা বলে, শিকার যেন বুঝতে না পারে। বুঝলেই কাজ শক্ত হয়ে যাবে। তখন ও শেষ কামড় দেবে।

শনিবার আঘাতের দিন। দিন তিনেক বাকি। স্যারের বাড়ি মনসাতলায়। ঘন্টাখানেকের রাস্তা। স্কুলে এখন গরমের ছুটি। রাস্তায় ওঁকে পাওয়া যাবে না। ফুটে চিন্তিত গলায় বলে, বাড়িতেই কাজ কর। ঝামেলা নেই। শ্বশুরবাড়ির আদর পাবি।

তিন
শনিবার। দীর্ঘ পাঁচ বছর বাদে স্যারের বাড়ির সামনে কনকচাঁপার গাছটা বড় অচেনা মনে হয়। কত নতুন ডাল আর অঙ্গবিন্যাস নিয়ে ওটা আজ দাঁড়িয়ে। বাড়িটা যেন দূর গঞ্জের পরিত্যক্ত মন্দির। গায়ের ছাল ফেটে লাল সুরকির দগদগে ঘা। নারকেল দড়িতে জানলার পাল্লা বাঁধা। এক চিলতে বাগান। রাঙচিতের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সামনে তুলসী মঞ্চ। পত্র-বিহীন কঙ্কালসার বৃক্ষদেবতা। রাশি রাশি মঞ্জুরি। জীবিত কিংবা মৃত। নিভু নিভু সন্ধা প্রদীপ। আমার কৈশোরের তীর্থমন্দির। শেষ প্রেম। স্থবির হয়ে যাই। দূরে ফুটেকে রাস্তায় লুকিয়ে থাকতে বলি, স্মরণ করিয়ে দিই, গুলির শব্দ যেন চলে আসে।

দূরে সাঁতরাগাছির ঝিল থেকে ভেসে আসে ঝাঁক ঝাঁক বুনো হাঁসের ডাক। অস্পষ্ট কিন্তু তিক্ষ্ণ। সন্ধার সেই সকরুণ হংস বিলপন ধীরে ধীরে আমায় সম্মোহিত করে। নেশাড়ুর মতো সদর দরজায় পা দিই। পাল্লায় চাপা আর্তনাদ। বাড়িতে মানুষের চিহ্ন নেই। প্রায় অন্ধকার ঘরে তক্তপোশ পাতা। একদিকে বইয়ের রেক-ঠাসা বই। পা টিপে টিপে এগুই। পাকা নিশিকুটুম্বের মত। শক্ত কিছুতে আঘাত লাগে। ঝিন ঝিন করে ওঠে পায়ের বুড়ো আঙুল। স্যারের হামানদিস্তা। পান ছিঁচে খান। সেই কোন কালে ওঁর দাঁতগুলো চলে গেছে গোরা সাহেবের ঘুঁসিতে। ঘরের মধ্যে ভ্যাপসানি গন্ধ- দেওয়াল থেকে ঝরে চুন বালির। আশ্চর্য। এরা কি সব উঠে গেল!

ভেতর দালান ফাঁকা। কোণে ক'টা বাক্সপ্যাঁটরা থরে থরে সাজানো। এক দেওয়ালে নাইলনের দড়ি। মেয়েদের সাজ পোষাক ঝুলছে। শাড়ি, ব্লাউজ, ছেঁড়া অন্তর্বাস। দেওয়ালে আঁটা কোনাকুনি ভাঙা একটা আয়না। তাতে একরাশ রঙিন টিপ। নৈঃশব্দের গাঢ়তা চারদিক থেকে আমায় কুরে কুরে খায়। ঘুণপোকার মত। হঠাৎ সদর দরজা খোলার আওয়াজ পাই। নিজের অজান্তে পাইপগানে হাত চলে যায়।

মুন্নি ঘরে ঢোকে। প্রায় অন্ধকারে এক অশরীরী জীবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিকট চিৎকার করে- কে? শব্দের ঢেউ চার দেওয়ালে ধাক্কা খায়। একযোগে আক্রমণ করে আমায়। আমি লাফিয়ে সামনে চলে আসি। ওর মুখ চেপে ধরি, বলি আমি অভি।

ও ফোঁস ফোঁস করে হাঁপায়। হাতের চেটোয় মোটা ঠোঁটের ঝাঁক ঝাঁপানি। সেই নিষ্প্রভ সন্ধ্যার নীরবতায় আমি চুম্বন করি আমার বাল্যঅনুরাগিণীকে। ডালিমের ছোঁইয়ায় পেঁজা তুলোর কোমলতা। মুন্নি অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকে। এক সময় ঘুমন্ত গলায় বলে অভিদা, কতদিন পরে তুমি এলে।

ঝিমধরা মাথায় তখন ওর আঙুলের চুপি চুপি খেলা। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নেই। মুন্নির থেকে দূরে সরে আসি। জানালার বাইরে মিশকালো অন্ধকার। ও ঘরের আলো জ্বালে। হাঁটু ফ্রকের কিশোরী এখন পূর্ণ যুবতী। সারা শরীর ঝাঁ ঝাঁ করে। জিজ্ঞাসা করি, বাড়ির আর সব কই?

-আর সব? মুন্নির হাসি যেন বড় করুণ।

-দিদিরা? স্যার?

-বড়দি পল্টুদাকে বিয়ে করেছে।

অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করি, পল্টুদা?

-হ্যাঁ পল্টুদা তুমি ঠিকই ধরেছ। শালিমারে ওয়াগান ভাঙে। প্রেম করে বিয়ে করল। না করেই বা করবে কি? বাবাতো বিয়ে দিতে পারতেন না।

-দেখা হয়?

-মাঝে মাঝে। লুকিয়ে। বাবা স্কুলে থাকলে দুপুরবেলা চলে আসে। এখন হাড়গিলে পাখি। পল্টুদা রাতে মদে চুর হয়ে আসে। আর দিদিকে ঠেঙায়। দিদি এখন এসে শুধু কাঁদে।

-আর মেজদি? রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করি।

-কলেজ থেকে একদিন বাড়ি ফিরল না।

-বাড়ি ফিরল না?

-হ্যাঁ, বাড়ি ফিরল না। কত খোঁজাখুঁজি হল। থানা, পুলিশ, কাগজ, রেডিও। সবই বৃথা গেল।

-তোমরা আর খোঁজ করলে না?

-খোঁজ করে কি লাভ। মুন্নি দার্শনিকের মতো উত্তর দেয়। অবাক হই। প্রশ্ন করি

-কেন?

-যে ইচ্ছা করে হারায় তাকে কি কেউ পায়? আমি দিদির ব্যাগে কতদিন দামী জিনিস পেয়েছি- সেন্ট, হেয়ার রিমুভার, আরও কত কি? সব তোমাকে বলা যায় না। জিজ্ঞাসা করলে মুচকি হাসত। আর বলত, এখন পচে লাভ কী? পচতেই যদি হয় তবে..., বলে থেমে যেত। তারপর খিল খিল করে হেসে বলত, দেখতেই পাবে।

মুন্নি আবার কাছে সরে আসে। মেয়েলী ঘন গন্ধ। কালো সার্টিনের মতো ঝাঁকঝাঁক চুল। পাইপ গানের রডটা বিশ্রীভাবে খোঁচা দেয়।

-সেজদি আর নদি সিংজীর ল্যাম্প কারখানায় কাজ নিয়েছে। চল্লিশ টাকা রোজ। মালিক খুব ভাল। টিফিনে পাঁউরুটি আর চা দেয়।

সেই ছোট কিশোরী আজ কত পরিণত। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। অবাক হয়ে চেয়ে থাকি।

-আমার কথা জিজ্ঞেস করলে না? ও হাত কোমরে রেখে টান টান হয়ে দাঁড়ায়। আমি জিজ্ঞাসু চোখে চাই।

-সকালে দুধের ডিপোয় কাজ করি। বিকেলে টিউশানি। এখন পড়িয়ে ফিরছি। ও তৃপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়।

সময়ের কারসাজিতে কত ঘটনার অভিনয় ঘটে। গত পাঁচ বছর-মানে ক'টা এলোমেলো দৃশ্য। পরীক্ষাগার দাউ দাউ করে জ্বলে। অম্ল, ক্ষার, বহুবিধ রাসায়নিক দ্রব্য। উৎকট গন্ধ। নিস্তেজ গিনিপিগ। পণ্ডিতেরা চুপচাপ। মলোতটভ ককটেল। নাগিনীর নাচের মতো পুড়ে যায়- লক্ষ লক্ষ শব্দের ভাণ্ডার। নাভির তলায় শাড়ি। রোমশূন্য বগল। বিয়ারের ঢেকুর। বোকা মাস্টারের বোকা ফসল! আজ দিনান্তের বিষাদময়তা ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে এ ঘর, মুন্নি আমায়।

-তুমি বাবার ঘরে বোস। এক্ষুনি এসে যাবেন। এক কাপ চা করে আনি। ওর গলায় স্বাভাবিক সুর ফিরে আসে। তারপর কি ভেবে উচ্ছাসিত গলায় বলে, বাবা সেদিন তোমার খুব সুখ্যাতি করছিলেন। তুমি না থাকলে ওরা নাকি বাবাকে মেরেই ফেলত।

আমার সঙ্গে ওদের এই দূরত্বে নিজের অজান্তেই যেন মনটা খুশি খুশি হয়। স্যারের ঘরে দাঁড়িয়ে চার দিকে চোখ বুলাই। দুটো দরজা। একটা দালানের দিকে আর একটা রাস্তার দিকে। চেয়ারটা তক্তপোশ থেকে ফুট তিনেক দুরে রাখি। স্যার তক্তপোশে বসলে আমার সুবিধা। এত কম রেঞ্জে শিকার কিছুতেই ছাড় পাবে না। গুলির শব্দ শুনলেই ফুটে চলে আসবে। আমি পালাব। তারপর ফুটের ভোজালির কাজ। নিখুঁত পরিকল্পনা, শুধু শিকারের অপেক্ষায় বসে থাকা।

মুন্নির ডাকে সংবিত ফিরে আসে। ও কোমরে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হাতে চায়ের পেয়ালা।

মুখ থেকে অজান্তে বেরিয়ে আসে-পাকা গিন্নী। ও উত্তর দেয়- তবে কি দুধের মেয়ে?

-তাতো বটেই অন্তত চাকরিসূত্রে।

মুন্নি প্রাণ খুলে হাসে। বলে- জানো অভিদা? আজ না কতদিন বাদে এত জোরে হাসলাম। এ বাড়িতে এখন আর কেউ হাসে না, জোরে কথা বলে না। সবাই ফিস ফিস করে। কী ভাল যে লাগছে। তুমি মাঝে মাঝে এখানে এস অভিদা।

আমার পরিকল্পনা উল্টে পাল্টে যায়। স্যার এখনও এসে পৌঁছননি। এক অকারণ উল্লাস আমার গভীরে আরো শিকড় কেটে বসে।

সদর দরজায় আওয়াজ হয়। শিকারীর দৃষ্টিতে দরজার দিকে চাই। মেজদি আর ন'দি। দুই ক্লান্ত যুবতী। ভাষাহীন চোখ। পরনে ছাপা শাড়ি। আর গুটিকতক কাচের চুড়ি। রাঙাদি ফিস ফিস করে, অভি না?

রাঙাদিকে দেখে অবাক হই। পাঁচ বছরে কত বুড়িয়ে গেছে।

আমাদের একা ফেলে রাঙাদি হঠাৎ বলত- তোমরা গল্প কর অভি, ভাতটা দেখে আসি। তারপর দ্রুত বেগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেত। আমি মুন্নির আঙুলে আঙুল জড়িয়ে খেলা করতাম। অনেকক্ষণ পরে মনে হত কিছু একটা বলা দরকার।

-মুন্নি, দেখো দেখো চাঁদটা দেখো। ঠিকযেন চাঁপাগাছটার ডালে নেমে এসেছি। মুন্নি উদাস সুরে বলত, পেড়ে দেবে?

ছাদের সিঁড়িতে পায়ের শব্দে মুন্নির থেকে দুরে সরে বসতাম। রাঙাদি এসে গম্ভীর গলায় বলত- রাত হয়েছে অভি, বাড়ি যাও। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যেত। চাঁপার গন্ধভরা সেই জ্যোৎস্না রাতে রাঙাদিকে ভীষণ সুন্দরী মনে হত। চুরি করে দেখতাম। মুখে কপট গাম্ভীর্য। ঠোঁটে অভিমান। আধবোজা চোখ। নিজের মনে ধরা গলায় কি যেন সব বলত। ভাঙা গলা শুনতাম।

-আজ বাড়ি যাও অভি, পরে এস।

বোনেদের মধ্যে সবচেয়ে মৃদুভাষিনী ন'দি। ফর্সা, লাজুক। কিন্তু আজ যেন অতীতের ক'টা ছেঁড়া পাতা। গালে মেচেটা, সারা শরীরে কালো কালো দাগ। ব্লটিং পেপারে রক্ত-চোষা চেহারা।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলি। বুকের মধ্যে চাপ চাপ কষ্ট। দম বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করি, ভাল আছ ন'দি?

ন'দি নিরবে মাথা নাড়ে। চোখে ভয় মেশানো জিজ্ঞাসা। ন'দির ভাষাহীন ভাষা আমার হৃদকম্পন দ্রুততর করে। মনে হয় চিৎকার করে বলি- আমিই সেই ঘাতক, সাবধান। সব ওলট পালট করে দিয়ে যাব। কিছু একটা করো। নয় মারো, না হয় মরো। হাতে তুলে নাও সৃষ্টির এই যন্ত্র। ওদের দুর্গে কামান দাগো। এ রকম দগ্ধে দগ্ধে মেরো না।

-অভি তুমি বসো। মুন্নির সাথে গল্প করো। আমরা আসছি। ন'দি আর রাঙাদি ভেতর ঘরে পা বাড়ায়। ও আপনমনে বাইরের ঘন অন্ধকারে কি যেন খোঁজে। আনমনা গলায় বলে- অভিদা, একটা সত্যি কথা বলবে? মুন্নির চোখে চাপা কৌতুহল। বলে

-তুমি এতদিন বাদে এলে কেন?

প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তৈরি ছিলাম না। অস্বস্তিতে পড়ে যাই। ইতস্তত মনে উত্তরও ভাঁজি।

আমার কোনও প্রতিক্রিয়ার আগেই ও বলে- আমি জানি।

-কি জান? আমি রুদ্ধ স্বরে প্রশ্ন করি।

-তুমি কেন এসেছ?

ওই স্বভাব-সরল মেয়েটা আমাকে অবাক করে। ওর মনের গভীরে জট পাকানো ভাবনাগুলোর গিট ছাড়াবার চেষ্টা করি। ভীত কন্ঠে বলি-কেন এসেছি?

-জানি, কিন্তু বলব না। বেশ তৃপ্ত মনে ও উত্তর দেয়।

আমি অভিষেক, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অর্ধশিক্ষিত বিপ্লবী যুবক। বর্তমানে প্রেমিক রূপধারী ভীরু সংহারক। গলে গলে যাই। বড়দির লাগানো চাঁপার ডালে ওঠা চাঁদকে মনে হয় পেড়ে আনি। মনের কোণে লুকিয়ে থাকা বাসনার তপ্ত নিঃশ্বাস শুনি। বড় দুর্বল হয়ে পড়ি।

আমি স্বভাবে ভীরু। অন্ধকারে ভয়, নিঃসঙ্গতায় ভয়, ভয় আমরা আশৈশব সাথী।

ছেলেবেলায় স্নানের ঘরে যেতে ভয় করত। মায়ের আঁচল ধরে যেতাম। স্কাই লাইটের ফাঁক দিয়ে একটা বিকট মুণ্ডু আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। স্বপ্নে দেখতাম, জাঁতাকলে আটকে ছটফট করছি। প্রচণ্ড চেষ্টায় গলা ফেটে যেত। মা বুক থেকে হাত সরিয়ে ঠেলে তুলতেন- উঠে বস, বোবোয় পেয়েছে।

সেই বোবো এখন আমায় তাড়া করে। হঠাৎ হঠাৎ আক্রমন করে। একদম ঠাণ্ডা মেরে যাই।- কি ভাবছ? চুপ হয়ে গেলে? মুন্নি প্রশ্ন করে। শীতল গলায় বলি- তুমি জানলে কি করে আমি কেন এসেছি?

মুন্নি কথা নেয়। অভিদা, তুমি আবার পড়াশুনা করো না। ইলেকট্রনিক্স। লেখাপড়ায় কত ভাল ছিলে। আগুনের লকলকে শিখায় স্টুয়ার্ড হস্টেল জ্বলে ওঠে। এক ঝাঁক ননীর পুতুল। ধনাত্মক চশমা, রুক্ষ চুল, মাপা হাসি। পাসপোর্ট, এম এস-এম আই টি। গেঞ্জিব্লাউজ, গ্রিনল্যান্ড মেটারনিটি। স্কুল বাস, ধনাত্মক চশমা। উলঙ্গ কপিকুল ছটফট করে।

-কথা ঘুরিয়ো না মুন্নি জবাব দাও। আমি কেন এসেছি?

-বললাম তো বলব না। মুন্নি জানলার শিক ধরে মিটিমিটি হাসে। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে খুশির সুরে বলে ওঠে- বাবা। তোমার জন্য অভিদা কতকক্ষণ বসে।

স্যার আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুখের দিকে চেয়ে কিসের যেন খোঁজ করেন। ভ্যাপসা গরমে গায়ের জামা সপসপে ভেজা। নাকের ডগায় নেমে এসেছে চশমা। বগলে যথারীতি ছাতা। বিদ্যাসাগরী চুল তেলের অভাবে রুক্ষ।

-অভি জামাটা খুলে ফেলি? কি বল বাবা?

উত্তরের অপেক্ষা না করে উনি গেঞ্জি জামা দুটই খুলে ফেললেন। মৌজ করে তক্তপোশে বসতে বসতে বলেন- তুমি আরাম করে বসো বাবা। দ্বিধা করো না, গায়ের জামাটা খুলে ফেল, যা গরম।

আমি উত্তেজিত হয়ে বলি- না, না ঠিক আছে। নিজেরই অবাক লাগে। অজান্তে তলপেটে হাত চলে যায়।

স্যার আমার কন্ঠস্বরে অবাক হন। তারপর হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলেন, অভি, আমি খুশি। খুব খুশি।

বিস্মিত গলায় বলি, কেন স্যার?

-কেন মানে?উনি উত্তেজিত হন। বুকের পাঁজরাগুলো হাঁপরের মত ওঠানামা করে।

-তুমি সাহসের পরিচয় দিয়েছ। ভীষণ সাহস। তুমি প্রফেসনাল কিলারের কাছ থেকে আমায় বাঁচিয়েছ। উনি দম ভরে নিঃশ্বাস নেন।

আমার মৌনতা সাক্ষি থাকে। উনি ব্যাথিত কন্ঠে বলেন- মরতে ভয় পাই না, জীবনে যাকে সত্য বলে ভাবি, তাকে কী করে অস্বীকার করি। কেন চুপ করব? কার ভয়ে?

মুন্নি রেগে যায়। বলে, তুমি এসেই অভিষাকদাকে জ্ঞান দিতে আরম্ভ করলে? এরকম করলে অভিদা আর আসবে না।

-জ্ঞান মানে? সত্য মানেই জ্ঞান? অভি, তুমি ভয় করো না। যাকে সত্য বলে যান তাকে আঁকড়ে ধর। জয় তোমার হবেই।

আমি শুকনো হাসি। মা, মুন্নি, মাস্টারমশাই, এরা চিরটা কাল আমায় দুর্বল করে দেয়। এদের ভাল করার ইচ্ছা অকটোপাসের মতো আমায় আক্রমণ করে। অকৃতকার্য হই। বার বার। যখনই এর উৎসমুখে যাই- মায়ের চোখে সকরুণ মিনতি দেখি। মুন্নির মুখে এলাচির গন্ধ পাই। স্যারের লেকচার শুনি। পরীক্ষার ফল আমার অজানা নয়। বুকের ভেতর গোঁ গোঁ শব্দ। বোবোয় পেয়েছে।

-স্যার একটা কথা বলার ছিল।

-কি কথা?

-একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। ওরা আপনাকে মারতে চায়। বহুদিন পর নিজের কন্ঠস্বর অচেনা লাগে।

-জানি অভি, আমি জানি। আমার জন্য চিন্তা করো না। তুমি বাড়ি যাও। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

-কিন্তু স্যার ব্যাপারটা আপনি গুরুত্ব দিন। এত সহজ নয়। আমার মারার রিতিমত ট্রেনিং হচ্ছে।

-জগতে সব লক্ষ্যে পৌঁছনরই ট্রেনিং আছে। এটা আর নতুন কি? তুমি বিপ্লবী, লক্ষ্যে পৌঁছেছ। বলো, কত কষ্ট, কত বেদনার সিঁড়ি বেয়ে তুমি এখানে এসেছ।

তক্তপোশ থেকে নেমে শীর্ণ হাতে আমার কাঁধ চেপে ধরেন। গম্ভীর গলায় আমায় আদেশ দেন,- বাড়ি যাও অভি, রাত অনেক হল, মা চিন্তা করছেন।

বাঁদরের হাড়ের মতো পাইপগানটা তলপেটে খোঁচা দেয়। দরজার দিকে এগিয়ে যাই। মুন্নি আমার পাশে এসে ফিস ফিস করে- ওসব বাজে কথা, তাই না অভিদা? তুমি আমায় দেখতে এসেছিলে।

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিকষ আলো চাদরে সারা আকাশ ঢাকা। চাঁদহীন আকাশ। ঝাঁপ বন্ধ দোকানপাট। ক'দিন ধরে চিরুনী তল্লাসী চলেছে। তারপর এনকাউন্টার ডেথ!

বড় ক্লান্ত। ঘুম পায়। মায়ের কথা মনে পড়ে।

ঘাড়ে পালকের ছোঁয়া লাগে। পাথরের চোখ। জ্যান্ত চোখের হলদে মণিতে ফড়িং-এর নাচ। দূরে মুন্নিদের কনকচাঁপার গাছটা স্পষ্ট দেখতে পাই। ডালে এক বিকট মুণ্ডু।

মাগো!

সমাপ্ত