Thursday, July 26, 2012

জীবিকার সন্ধানে

লেখকঃ প্রগতি মাইতি
জীবনানন্দের 'রূপসী বাংলা' । ওই নামে আবার ট্রেন। ভোরে হাওড়া থেকে ছেড়ে পুরুলিয়া যায়। সৌম্য ওই ট্রেনটাই বেশি ধরে। খুড়তুতো ভাই প্রীতম থাকে মেদিনীপুরের সদরে। বছরে প্রায় বার কুড়ি সৌম্যকে মেদিনীপুরে যেতে হয়। প্রথম প্রথম হোটেলে গিয়েই উঠত। জানাজানি হয়ে যেতে প্রীতম-সোহেলী রাগারাগি করে। অতঃপর মেদিনীপুর গেলেই ভাইয়ের বাড়ি থাকে। ব্যাবসার জন্য সৌম্যকে পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে যেতে হয়। কোন ট্রেন কখন ছাড়ে, কখন পৌঁছায়, কোন বিশেষ স্টেশনে কতক্ষণ দাঁড়ায়, সবই আই টি'র মতো মেনুতে ঢুকলেই ডিসপ্লে। সৌম্যের ব্যাবসা ঘটনাক্রমে এমন সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে তাকে ট্রেনেই বেশি যাতায়াত করতে হয়। দূরপাল্লার ট্রেনে ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ সৌম্যের, কয়েক দিন আগের 'রূপসী বাংলা'র অভিজ্ঞতা একেবারে অভাবনীয়। মানুষের জীবিকার ওপর সাধারণ ভাবনা চিন্তাই পাল্টে যায়।

বাড়িতে কাজের মেয়ে নিয়ে পিয়ালীর সঙ্গে সৌম্যের অশান্তি লেগেই থাকে। সৌম্যের যুক্তি, তোমার কাছে কোনও মেয়েই টিকতে পারে না। পিয়ালীর জবাব, তুমি তো আর এদের ট্যাকেল করো না যে বুঝবে।

-কিন্তু হার্ড ট্যাকেল হলেই ফাউল হয় তা তো জানো।

-এটা ফুটবল মাঠ নয়।

-তা হলেই তো হত।

-আদিখ্যেতা করো না।

-আরে বাবা, এগারো জন সুশৃঙ্খলভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলেই তো হয়।

-কি বলতে চাইছ, খুলে বলো।

-আমি বলছি, একজন কাজের মেয়েকেও তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না।

-বিশ্বাস করা যায় না, তাই করি না।

-বাজে কথা। তোমার খুঁত খুঁতে স্বভাবের জন্য কেউ টিকছে না।

-বুড়ি, স্বপ্না, বাপির মা, সন্ধ্যা এদের তুমি চেনো না?

-আমার চেনার দরকার নেই।

-তা হলে বেশি বোকো না।

-বকতে আমি চাইও না। কিন্তু দু'দিন অন্তর কাজের মেয়ের আমি আর যোগান দিতে পারব না।

বিল্টুকে ভোর ছ'টা দশে বাস্ট্যাণ্ডে স্কুলের বাসে তুলে দিয়ে এসে সৌম্যর জন্য রান্না বসাতে হয়। সৌম্য বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই আবার বিল্টুকে আনতে যেতে হয়। সপ্তাহের তিন দিন দিদিমণির কাছে পড়তে যায় বিল্টু, সঙ্গে পিয়ালী, দু'আড়াই ঘণ্টা ঠায় বসে থেকে দুটো বাস পাল্টে বাড়ি ফিরে আবার রাতের দক্ষিণ হস্তের জন্য রান্না ঘরে ঢোকে পিয়ালী। এ ছাড়া আগে সপ্তাহে একদিন সাঁতার, আর একদিন আঁকার স্কুল। সৌম্য সকাল দশটায় বেরিয়ে বাড়ি ফেরে রাত এগারোটায়। সৌম্য যখন রাতে বাড়ি ফেরে তখন বিল্টুর এক ঘণ্টা ঘুম হয়ে যায়। আবার সকালে যখন বিল্টু স্কুলে যায় সৌম্য তখনও ঘণ্টা দুয়েক ঘুম বাড়ি থাকে। পিতা পুত্রের মুলাকাত সেই রবিবার। রবিবার সৌম্য বাজার দোকান, লণ্ড্রি, সেলুন, হ্যালো পাড়ার কন্টাক্ট-এ সব নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয় যে বিল্টুকে রবিবারও সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না সৌম্যের। এ নিয়ে পিয়ালী কম অশান্তি করেনি।

-তুমি জীবিকার সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছ, আর ছেলে ক্রমশঃ দূরে...

-বুঝি, সব বুঝি, কিন্তু সময়টা না পেলে করব কী?

-লাভ কম করো। অর্থের জন্য...

-তুমি কি বলতে চাইছ? টাকার দরকার নেই?

-নিশ্চই আছে। কিন্তু টাকাই তো সব নয়!

-তুমি ভাবজগতে বিচরণ করছ। টাকা না থাকলে তোমার জীবনযাত্রার মান কিংবা বিল্টুর জন্য এত খরচ সম্ভব হত?

-আসলে তুমি জীবিকার জন্য যতটা ভাবিত ততটা জীবন নিয়ে ভাবছ না।

-আমার জীবিকা তো তোমার জীবনেরই জন্য।

সৌম্য যে এ সব বোঝে না তা নয়। পিয়ালীও যে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে করতে ক্লান্ত-তাও জানে। আসলে এমন ভাবে সৌম্যের জীবন ও জীবিকা ঘটনাক্রমে যুক্ত হয়েছে, সেখান থেকে সহজে ব্যাতিক্রমী কিছু করা মানেই ছন্দপতন হবে। মাসের মধ্যে অন্তত এক সপ্তাহ সৌম্য বাড়ি ফেরে না। হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায়। থালা-বাসন মাজা ও ঘর মোছার জন্য ঠিকে ঝি আছে। বাইশ বছর ধরে গৌরী এ কাজে নিযুক্ত এবং গৌরীর ব্যাপারে পিয়ালীর কোনও অভিযোগ নেই। যত অভিযোগ হোলটাইমার নিয়ে।

বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে তাড়াহুড়ো করে গলার হার বিছানার নীচে রেখে দিয়েছিল পিয়ালী। স্বপ্না নাকি তখন ওই ঘরে ছিল। দিন তিনেক বাদে হারের খোঁজ না পেয়ে স্বপ্নার ওপর চটপাট। স্বপ্নার চাকরি চলে যায়। খাটনি বাড়ে পিয়ালীর। হঠাৎ একদিন ছেঁড়া তোষকের মধ্যে থাকা অবস্থায় হার আবিষ্কৃত হয়। তত দিনে স্বপ্না অন্যত্র রি-এমপ্লয়েড। দোষ ঢাকতে অগ্যতা দিন কয়েক নিজেই সব কাজ করে সৌম্যকে দেখায়-নো প্রবলেম। আবার পুর্ববৎ। অনেক খোঁজাখুঁজি করে নিযুক্ত হয় বাপির মা।

মাসকাবারির দেড় কিলো মুসুর ডাল ষোলো দিনেই হাপিস। অথচ পিয়ালীর স্মৃতিশক্তি নির্ভর হিসাব বলছে, বড়জোর দিন দশেক ডাল হয়েছে। সৌম্যের খোঁচাতে পিয়ালী বলে, আরে বাবা, ষোলো দিনই যদি ডাল হয় তা হলেও তো দেড় কিলো লাগে না? হাল্কা কথা বলে সৌম্য ব্যাপারটা লঘু করার চেষ্টা করে। হিতে বিপরীত হয়। পিয়ালীর গলা চড়ায় ওঠে। রীতিমত উত্তেজিত পিয়ালীর বলে, ডাল না হয় ছেড়ে দিলাম, কিন্তু চাল? গোঁফের নীচে ফুটে ওঠা হাসিতে সৌম্যের উক্তি, 'ভাল মিলিয়েছ তো? ডালের সাথে চাল-তাল আছে। দেখ আবার খোয়া গেছে কি না শাল, যা সব মাল।'

-সব ব্যাপারটা তুমি হাল্কা করে দেখছ।

-আচ্ছা বাবা, দেখা যাবে কাল।

এ বার পিয়ালী হেসে ওঠে। বলে, তুমি একটা মাল। সৌম্যের ছন্দ ঠিক করাই ছিল, তবু ভাল নইকো পয়মাল।

পরের দিনিই পিয়ালী ঘোষণা করে, চাল বাড়ন্ত, সৌম্য চুপ। আবার পিয়ালী বলে। এ বার সৌম্য বলে, সে কী এই তো সেদিন কুড়ি কেজি এনেছি।

-এ বার বোঝো। আমি এমনি -এমনি বলি?

এরপর সন্ধ্যা। সন্ধ্যার প্রধান দোষ না বলে-কয়ে দুম করে কামাই। দুপুরেরে এঁটো বাসনপত্র শেষে পিয়ালীকেই ধুতে হয়। বাড়িতে কোনও অতিথি আসার আগাম খবর সন্ধ্যাকে দিলেই হল। ঠিক কোনও না কোনও অজুহাতে সন্ধ্যা ডুব দেয়। পিয়ালীর খাটনি তত বাড়ে। দুটো ছেড়ে এখন তিন-তিনটে প্রাইভেট টিউটর। আঁচল ধরা বিল্টু একা একা পড়তে যাবে না। সর্বত্র পিয়ালীকে চায়া-সঙ্গী হতে হয়। গ্যাস-অম্বলে ভুগে পিয়ালী দিনকে দিন আরও খিট-খিটে হয়ে যায়। আগের মত তৎপরতা নেই। অগ্যতা ঠিক হয় একজন হোলটামার রাখা হবে। চারিদিকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হল। আত্মীয়-বন্ধু-বান্ধব সকলকে বলা হল আট-দশ বছরের একটা মেয়ে চাই। একেবারে কেউ যে এল, তা নয়। পিয়ালীর পছন্দ নয়।

সৌম্য একদিন এ নিয়ে যৎপরোনাস্তি অশান্তিও করে। সৌম্যের যুক্তি, দরকার যখন আমাদের, সুতরাং যাকেই পাওয়া যাক তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই হল। অ্যাত ছুঁতমার্গের কী আছে? সঙ্গে সঙ্গে পিয়ালী বলে ওঠে, তুমি কি বলতে চাইছ? দরকার বলে যাকে সামনে পাব এনে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দেব?

-তা হলে তোমার হোলটাইমার জোটা অসম্ভব।

-দরকার নেই আমার অমন হোলটাইমার।

তাও গৃহ অশান্তি এড়াতে সৌম্য যাকে পায় তাকেই একটা দশ-বারো বছরের মেয়ে এনে দিতে বলে। সৌম্যর কারখানায় বসিরহাট বনগাঁ থেকে যারা আসে তাদের তো রোজ পালা করে জিজ্ঞাসা করে। এই অছিলায় ভানুমতি দিন চারেক দেরি করে কারখানায় এসেছিল। দেরীর জন্য ভানুমতির যুক্তি-'বাবু, আপনার লগে মাইয়া খুইজতে গেছলুম, লক্ষ্মীদাঁড়ির একটা মাইয়া প্রায় হাতে এয়ে গেছল। মাইয়াডার নাম শুধালাম। বলে, সীমা। আমি কইলাম, সীমা কী? ও কইল, সীমা মণ্ডল। ঘরের দাবায় বইসে কথা বলছিলাম মাইয়াডার মায়ের লগে। অর বাপ আইল। তখন আমি উনারে সব খুইল্যা কইলাম। কইলাম, চাইরশো দ্যাবে, সঙ্গে খাবা পরা ফিরি। মাইয়াডার, বাপ কইল, আমার বইলবার কিছু নাই। অর মা-রে জিগাইছেন? আমি কইলাম হ্যাঁ। তখন হুঁকা টাইনটে টাইনটে লোকটা কয়, তা হিঁদুর বাড়ি না মুছলমান? আমি কইলাম, ক্যানে আপনার নাম কী? একমুখ ধুঁয়া ছাইড়া কয় কী, খোদাবক্স মণ্ডল। আর কথা? আমি দিন দুয়েক বাদে কইয়া যামু।' সৌম্য তারিয়ে তারিয়ে ভানুমতির কথা শুনছিল আর ভাবছিল কী সহজ সরল এই ভানুমতি। হাসতে হাসতে সৌম্য বলে, 'কেন মুসলমান তো কী হয়েছে? তা ছাড়া বাঙালি মুসলমান তো। সীমা নাম শুনলে তোমার দিদিমণি রাজি হয়ে যেত।' জিভ বার করে দু'হাতে কান ধরে ভানুমতি বলে, ছিঃ ছিঃ ছিঃ, অমন অলুক্ষণে কথা বলবেন না বাবু। ঠিকা ঝি তবু চলে, যে কী না রান্নাঘর, শুবার ঘর বেবাক ঘরে ঢুইকবে, খাবে, থাকবে-সে যদি মুছলমান হয় তো জাত যাবে বাবু। আমি আর এরকম কইরতে পারুম না। আমার অধম্য হবে।'

'রূপসী বাংলা' খড়্গপুরে ঢুকে মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করে। পেছনের কয়েকটা বগি খুলে ধউলি এক্সপ্রেস হয়ে অন্য ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হবে। সৌম্য জানালার ধারে বসেছিল। মাটির ভাঁড়ে চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরায়। আট-নয় বছরের ফর্সা ফুটফুটে মেয়ে একটা ফ্রক পরা হাতে ছোট একটা নারকেল কাঠির ঝাঁটা। মেয়েটার ফ্রকটা কোনও এক সময় সাদা ছিল। বারবার কাঁধ থেকে ফ্রকের ফিতে হাতার বাহুতে চলে আসছে। হাত দিয়ে বারবার ঠিক করে নিচ্ছে, চুল ডাই করে এখানে-সেখানে রঙ করতে হয়নি, অযত্নে লাল-কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনি। সৌম্য ভাবে এরা যদি আমাদের বাড়ির মেয়ে হত আদরযত্নে সবার নজড় কেড়ে নেওয়ার মত দেখতে হত। কামরার ভেতরে ঝাঁট দিয়ে ময়লাগুলো প্লাটফর্মের বিপরীত দিকে চালান করে দিয়েই একজন যাত্রীর কাছে পয়সা চায়। পয়সা কেউ দেয়, কেউ দেয় না, কেউ কেউ কপালে হাত ঠেকিয়ে জানান দেয় এসো। এ বার বগলে ঝাঁটা নিয়ে সৌমের কাছে আসে। পয়সা চায়। সৌম্য পকেটথেকে দু'টাকার কয়েন বের করে নিজের হাতে রেখে বলে তুই আমাদের বাড়ী থাকবি? চপল হাসিতে উত্তর আসে, 'কি দেবেন?'

- খাবি-দাবি থাকবি, জামা কাপড় দেব আর......... আর পাঁচশো টাকা দেব। চকিতে মেয়েটি উত্তর দেয়,

- দাঁড়ান আসছি।

- ট্রেন ছেড়ে দেবে তো,

- এখনও সময় হয়নি কো,

মিনিট তিনেকের মধ্যে মেয়েটি ফিরে এসে সৌম্যকে বলে, মা রাজী নয়।

- এর মধ্যে তোর মাকে পেলি কোথায়?

- ওই যে আমার মা বসে আছে,

- তোর মাকে ডাক, আমি কথা বলব।

- মা আসতে পারবে না।

- কেন?

- মা পুয়াতি।

- তোরা কয় ভাই বোন?

- চার বোন, দু'ভাই।

- তোর মা রাজী হোল না কেন?

- অত কম পয়সায় হবে না।

- কত চাই?

- আমি সারা দিন ট্রেনে-ট্রেনে ঘুরে একশ টাকা কামাই। কুড়ি টাকা আমার সারা দিন খেতে লাগে। বাকি মাকে দিই।

- তোর অন্য ভাই বোনেরা কি করে?

- দুজনে বাস স্ট্যান্ডে ভিক মাগে। আমার সাথে একজন এখানে ঘোরে। আর ছোটটাকে মা প্লাটফর্মে শুইয়েরেখে পয়সা তোলে।

- তোদের তাহলে অনেক আয় হয়।

- বাবা কিছু করে না। চোলাই খায় আর সাট্টা খ্যালে।

- তোরা পয়সা দিবি না।

- মাকে মেরে রোজ টাকা নিয়ে যায়।

ট্রেন ছেড়ে দেয়। অভ্যস্ত মেয়েটি চলন্ত ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নেমে যায়। স্বাধীন ভারতবর্ষে জীবিকার সন্ধানে সৌম্যর কাছে নতুন লাগে। জানালা দিয়ে সৌম্য মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। দৌড়ে আর এক প্লাটফর্মে যাচ্ছে। ওখানে তখন আর একটা ট্রেন এসে গেছে।

সমাপ্ত