Thursday, July 26, 2012

এক দাঙ্গাবাজের কাহিনী

লেখকঃ গোরা গাঙ্গুলি
সালটা হবে ১৯৭২ এর নভেম্বর মাস। তখন আমি আসামের এ মাথা থেকে ওমাথা - এক প্রান্তর থেকে আর এক প্রান্তরে চষে বেড়াচ্ছি। জানার চেষ্টা করছি আসামের প্রকৃতি -

ওখানকার মানুষকে। আমার দিকথেকে সবচেয়ে বড় অন্তরায় ছিল ওখানকার ভাষা, অসমীয়া ভাষা ভালভাবে না জানা। নলবাড়ী, বরপেটা এসব এলাকার ভাষা আর জোরহাট, শিবসাগর ডিব্রুগড়ের ভাষা - এদের উচ্চারণ আলাদা। ফলে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গেলে বুঝতে পারছি ভাষার উচ্চারণের তফাৎ। এই অবস্থায় আমি তখনকার ২/৩ জন বন্ধুকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য বরপেটার কাছে মানস অভয়ারন্য বেড়াতে গিয়েছি শীত আসবে আসবে করছে এমন সময়ে।

আমার কাহিনী শুরু করার আগে খুব অল্প কথায় মানস অভয়ারণ্যের কথা না বললেই নয়। বনজ সম্পদে মানস অভয়ারণ্য খুবই সমৃদ্ধ। দুধি, সাতিয়াকা, কুময়ুন, লামপাতি, আকাতরু, ভার্যমিল্ল, শিমুল, বহেড়া, অর্জুন, কুরিয়াল, জামুল, পলাশ, শিশু, গামারি ছাড়াও আরও কত যে গাছ তার হিসাব দেওয়া এই মুহুর্তে আমার কাছে সম্ভবপর নয়। কোথাও কোথাও শতাব্দী প্রাচিন গাছের গা বেয়ে উঠে আসে লতানে গাছের সারি, এখানে ওখানে কত ধরনের বুনোফুল - প্রজাপতির মেলা - দেখে দেখে মন আনন্দে ভরপুর। মাঝে মাঝে কচি সবুজ ঘাসে ছাওয়া প্রান্তর ছোট ছোট জলাশয়। পানকৌড়ি আর মাছরাঙা। বনপথ চলে এঁকে বেঁকে। কখনও সখনও সোজা মাঝে মাঝে ঝোরা বা ছোট উপনদী। বনের মধ্য থেকে ভেসে আসে কাঠঠোকরার ডাক। মাটি থেকে উত্থিত এক আদিম বনজ গন্ধ মাতাল করে দিচ্ছিল আমার নাগরিক মনকে।

এই অরন্যে মাংসাশী, স্তন্যপায়ী, তৃণভোজী সবরকমের পশু আছে। জঙ্গলের একেক প্রান্তে একেক ধরণের পশুর আধিক্য। কেপড় লাঙ্গুড়, সোনালী লাঙ্গুড়, লরিন, বনবেড়াল, লেপার্ড ক্যাট, বাইসন, গন্ডার, ২৪ শম্বর, নীলগাই, ডিয়ার, বার্কিং ডিয়ার, বাদুড় তো আছেই। এ তল্লাটে নানান ধরণের সরীসৃপের অভাব নেই।

মানস বড় বেশী অথচ বাঙময়, নিরাসক্ত অথচ মায়াময়, ভয়াল অথচ সালংকারা নারীর সিমন্তে মাঙ্গলিক রেখার মতোই রোম্যান্টিক। এই অভয়ারন্যে এক বহুবর্ন, নিবিড়, প্রশান্ত অবয়বময় যেন এক ঊষাকাল যার কোনদিন বয়স বাড়ে না। খরা তাকে প্লাবিত করলেও রিক্ত করতে পারে না। সারা আসামে মানস এবং কাজিরাঙ্গা দেখার মতন। বিশেষ করে যে মানস অভয়ারণ্য না দেখেছে সে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং অরণ্য দুটো থেকেই বঞ্ছিত হয়েছে।

যাই হোক এই অরণ্যের কাছেই হটাৎ আমার সঙ্গে দেখা হোল এক উদভ্রান্ত মধ্যবয়সী যুবকের - নাম সরল। তার কথায় এবার আসা যাক।

খুব কম বয়সে আমি পিতামাতাকে হারিয়েছি। ফলে জীবনে কষ্ট পেয়েছি, কোনো কোনো দিন খাওয়াও হয়নি। শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে আমি প্রাথমিক স্কুলের দরজাও পেরতে পারিনি। নানান কুসঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছি। আমি বহু মানুষকে খুন করেছি আমার নেতার নির্দেশে। শহরে বস্তি এলাকায়, শহরকে আতঙ্কিত করে একের পর এক বস্তীতে আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছি। কত নরনারী যে আমার আক্রমণে খতম হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। মনে পড়ে কোনো এক বস্তীতে সদ্য বিবাহিত কোনো এক শ্রমিক যুবককে হাত দুটো কেটে দিয়েছি তার যুবতী স্ত্রীর সামনে। কোথাও বৃদ্ধা মায়ের সামনে তার ছেলেকে ডেকে এনে তার বুকের মধ্যে আমুল বসিয়ে দিয়েছি লম্বাছুরি যার আঘাতে সে ইহলোক ত্যাগ করেছে। একবার দাঙ্গা করতে গিয়ে এক ছোট্ট শিশুর হাস্যজ্বল মুখের সামনে তার বাপ মা দুজনকেই কেটে ফেলি - শিশুটি তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি বা তার মুখভাবে তার প্রতিফলন পড়েনি। আর একবার এক স্ত্রীর সামনে তার স্বামিকে ছুরি মারার পর যখন আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্ত্রীর দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলাম তখন তার স্ত্রী হটাৎ দুহাত বাড়িয়ে আমার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নখ দিয়ে আমার মুখ ফালা ফালা করে দিলো। কোত্থেকে যে সে সেই শক্তি পেয়েছিলো জানি না। কিছুক্ষনের জন্য আমি হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমি আত্মস্থ হই। পরে ওর ওপর ভয়ানক অত্যাচার করি - এমন অত্যাচারে ঐ বউটি পরে মারা যায়। এছাড়া আমি আরও অনেক অনেক ছোট ছোট মেয়ের উপর অত্যাচার করি। তাদের কথা ভাবলে আমি নিজেকে ধিক্কার জানাই। নিজের উপর বিতৃষ্ণা জন্মায় তাদের করুন বিভৎস মুখের কথা যখন ভাবি তখন রাত্রে ঘুম আসে না। রাতের পর রাত জেগে থেকেছি।

আমি ১৮ বছর বয়সে দাঙ্গায় হাতেখড়ি নিই। তারপর প্রায় ৪৫ বছর বয়স পর্য্যন্ত আমি একাজ নিয়মিত করে যাই। এর জন্য প্রচুর পারিশ্রমিক পাই। নেতার নির্দেশে দিনের পর দিন একাজ করতে করতে আমি একেক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। জীবনে প্রচুর টাকা আয়ও করেছি এসব কাজ করে। অথচ আমার মত বিবেকহীন মনুষ্যত্ববর্জিত দাঙ্গাবাজ যথা সময়ে বিয়েও করি ও ছেলেমেয়েও হয়। আমার স্ত্রী ছিলেন সুন্দরী ও শান্ত স্বভাবের নারী। প্রথমে একটি মেয়ে তারপর পরপর দুটি ছেলে হয়। সংসার বেশ চলছিল অভাব অনটনের কোনো ব্যাপারই ছিল না। হটাৎ একদিন স্ত্রী জানতে পারে আমার কার্য্যকলাপ এবং মানষিকভাবে মুষড়ে পড়ে। হটাৎ একদিন মাথা ঘুরে খাটের থেকে পড়ে গিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়ে। চলাফেরা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমার বড় মেয়েকে সংসারের হাল ধরতে হয়, স্ত্রীর বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে নানান রকম চর্ম রোগ দেখা দেয়। আমার স্বভাবের ঠিক উল্টো হবে বলেই মেয়েটি শান্ত ও নিশ্চুপতার প্রতীক ছিল আর এই নিশ্চুপতার জন্যই আমার মধ্যে যেন কোথাও ওর প্রতি একটা অদ্ভুত স্নেহ ভালবাসা জন্মে গিয়েছিল। আমার এই মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার আমি ভাল পাত্রর সন্ধান করতে লাগলাম। আমার কপালের দোষেই হোক, বা অন্য কোনোও কারনেই হোক মাত্র সাতদিনের জ্বরে কোনোও চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটা যখন মারা গেলো তখন প্রথম আমার চোখে জল এল। দুঃখে গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে উঠলো। একটু একটু করে আমার সুঠাম বলিষ্ঠ দেহ ঝুঁকে গেলো।

এই রকম এক দাঙ্গার মাঝেই দীর্ঘদিন অসুস্থ আমার স্ত্রীর মৃত্যু হলো। শ্মশান থেকে ফেরার পরদিন থেকে আমার বড় ছেলেকে আর পাওয়া গেলো না, যেন হারিয়েই গেলো। আমি আবার এক বড়সড় ধাক্কা খেলাম।

বার প্রয়োজন হোল দাঙ্গার। নেতা মশাই দাঙ্গাকারীকে জরুরী তলব দিয়ে নির্দেশ দিলেন কোথায় কোথায় আবার দাঙ্গা বাধাতে হবে। এদিকে দিনে দিনে আমারও বয়স বাড়তে লাগলো। এরই মধ্যে শহরের বিভিন্ন এলাকায় দাঙ্গা করে তিন চারটি বাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে ভোর বেলায় বাড়ী ফিরে দেখি আমার ছোট ছেলেটা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে, টেবিলের উপর তার হাতের লেখা চিঠি। আমার প্রতি তীব্র ঘৃনা বশতই ছেলেটা গলায় দড়ি দিয়েছে বুঝতে পারলাম।

দাঙ্গাকারী কয়েকদিন চুপচাপ ঘরে বসে থাকলো এরপর সে বস্তীতে বস্তীতে রাস্তায় রাস্তায় সকলের কাছে মিনতি করতে লাগলো এবার তোমরা আমাকে মারে ফেলো। সে নিজেও কয়েকবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। ওর চোখের সামনে বারবার শিশুটির খলখলে হাসি, মেয়েটির বাড়িয়ে তেড়ে আসা, বৃদ্ধা মায়ের বিলাপের ছবি পরপর ফেসে আসে। বেশী বেশী করে আসে শিশুটির মুখ। শিশুটির মুখ ক্রমশ বড় হয়, হাসির আওয়াজও বাড়তে থাকে, শেষ পর্য্যন্ত ওর দুচোখ জুড়ে বসে শিশুটির মস্তবড় মুখ আর হাসিটা যেন কানফাটানো আওয়াজে পরিনত হয়। এই অবস্থায় ও যখন পাগলের মতন দুহাতে মাথা চেপে চিৎকার করতে যায় তখনই ওর চোখের সামনে ধেয়ে আসে সেই মেয়েটির নখ বাড়িয়ে তেড়ে আসা। ভয়ে ও দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে। কিন্তু তাতে কি নিস্তার আছে। তখন দুকান ভরে বাজতে থাকে সারাজীবন ধরে সমস্ত দাঙ্গার যতসব শব্দ। আতঙ্কে ও অস্থির হয়ে ওঠে - ছটফট করতে করতে এক সময় ভোর হয়।

এর মধ্যে একদিন দাঙ্গাকারী খবর পেলো শহর যেখানে শেষ হয়েছে তার কিছু পরেই এক ভয়ঙ্কর জঙ্গল আছে। সেই জঙ্গলে আছে সমস্ত ধরনের হিংস্র জন্তু জানোয়ার। বনের প্রান্তে যে সব কাঠুরেরা থাকে এরাও সেই জঙ্গলের ভেতর উপযুক্ত পাহারা ছাড়া ঢুকতে কোনও দিন সাহস করেনি। দাঙ্গাকারী তখন ভাবলো এবার বোধহয় এক নিষ্ঠুর ভয়ানক মৃত্যুকে ও আলিঙ্গন করতে পারবে - যারপর পাবে পরম শান্তি। কোনওদিন কোন মানুষ ওকে মারেনি। এমনকি ওর ধারে কাছে কেউ যেতে সাহস করেনি। এক্সময় দাঙ্গাকারী চেয়েছিল সকলে ওর উপরে অত্যাচার করুক যাতে ও নিজে যত অন্যায় করেছে তার কিছুটা শোধ হয়। কিন্তু জনপদে যখন তা কিছুতেই হলোনা তখন ও জঙ্গলে যাওয়াই স্থির করলো। একদিন সন্ধ্যার কিছু আগে ও অরণ্যের শুরুতে এসে পৌঁছল। সেখানে বসবাসকারী কাঠুরেরা অবাক হয়ে দেখল একজন ভয়ানক দর্শন লোক জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তারা ছুটে এসে বলল তুমি কে তা আমরা জানিনা কিন্তু এই জঙ্গলে গেলে রাতে তোমার আর রক্ষা নেই। কি নেই এই জঙ্গলে হায়না, চিতা, ভালূক, বাঘ সমস্ত ধরণের জন্তু এখানে আছে। তোমাকে ফালাফালা করে ছিঁড়বে। দাঙ্গাকারী তা শুনে উল্লসিত হলো। সে এক্ষুনি জঙ্গলে ঢুকবে কোনো কথা না শুনে সে জঙ্গলে প্রবেশ করলো।

সেদিন ছিল পুর্নিমার রাত আকাশের চাঁদটা একটা মস্তবড় গাছের আড়ালে পড়েছে, দাঙ্গাকারী জলাশয়ের ধারে চুপ করে বসে আছে কখন হিংস্র জন্তুরা এসে তাকে ফালাফালা করে ফেলবে এই অপেক্ষায়। সেদিন কী জানি কোনোও হিংস্র জন্তু ওর কাছে আসলোনা কারন এমনও হতে পারে ওর ভীষন দর্শন চেহারা দেখে তারাও হয়ত ওকে দেখে ফিরে গেছে। এই ভাবতে ভাবতে কখন যেন ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙল ভোরের পাখীদের কলকাকলিতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে এক সৌম্য দর্শন দাড়িওয়ালা গেরুয়াধারী মানুষের দেখা পেলো। বিভিন্ন কথাবার্তার মাধ্যমে ও জানতে পারল ঐ সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক একটি অনাথ শিশুর আশ্রম চালায়। প্রায় ৪/৫ কিলোমিটার দূরে। উনি একে নিয়ে গেলেন আশ্রমে এবং কিছুদিন থাকতে বললেন। ওনার অনুরোধে আমি ওখানেই শিশুদের মধ্যে বসবাস করতে করতে অখানকার মায়ায় পড়ে গেলাম।

এই হলো এক দাঙ্গাকারীর গল্প।

বেশ কিছুদিন (প্রায় বেশ কয়েকবছর পর) আমি আসামে গেছি নববর্ষের বিহু উপলক্ষে। একদিন এক বন্ধুর গাড়ি করে গৌহাটি থেকে বরপেটা অভিমুখে যাত্রা করলাম। যাওয়ার সময় মনে হল একবার ঐ শিশুদের অনাথ আশ্রমে যাওয়া যেতে পারে। সেখানে গিয়ে আমি ওকে পেলাম। বয়সের ভারে ক্লান্ত লাগছিল দেখতে। আমি দেখে চিনতে পারলাম। ও যে খুব ভালো আছে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারলাম একটা ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে ও যে ধন্য হয়েছে এটা বললো। বেশ কিছুক্ষন শিশুদের মধ্যে কাটিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।

সমাপ্ত