Thursday, July 26, 2012

বন্ধুত্ব

লেখকঃ ফ্রান্সিস বেকন
'যে মানুষ সব সময় একা থাকতে ভালবাসে সে হয় কোন পশু নয়ত কোন দেবতা'। এরিস্টটাল এই গল্প কয়টি কথায় একই সাথে চরম সত্য ও চরম অসত্যকে খুব ব্যতিক্রমীভাবে প্রকাশ করেছেন। কারন যে, মানুষ অসামাজিক, যে, সমাজ সম্বন্ধে মনে মনে ঘৃণা পোষন করে, তার মধ্যে যে খানিকটা পশুর স্বভাব থাকবে এটা যেমন সত্য, তার সামাজিকতার মধ্যে দেবত্ব খুঁজে পাওয়া তেমনি অসত্য। অবশ্য এর একটা ব্যাতিক্রম আছে। কোন কোন মানুষ প্রতিদিনের পৃথিবী থেকে দুরে গিয়ে নির্জনে নিজেকে খোঁজেন, নিজের উত্তরনের পথ খোঁজেন, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু প্রাচীন সন্ন্যাসী এবং পবিত্র চার্চের যাজকদের মধ্যে এমন দেখা গেছে। কিন্তু নির্জনতা যে আসলে কী, কত দুরে তার বিস্তার, এটা সাধারন মানুষ কমই বোঝেন। কারন ভিড় তো আসলে সাহচর্য নয়, চারপাশের অনেক মুখ শুধুই সারি সারি সাজানো ছবি, আর ভালোবাসা যেখানে নেই, সেখানে কথা শুধু যেন বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার, কোন নৈর্ব্যত্তিক শব্দ মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। ' ম্যাগনা সিভিটাস, ম্যাগনা সলিচিউডো ' - ল্যাটিন ভাষার এই উক্তিটি সত্যের অনেক কাছাকাছি। এর অর্থ 'যত বড় শহর, ততই বেশি একাকীত্ব আর নির্জনতা'। বড় শহরে বন্ধুরা থাকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাদের প্রতিবেশী হিসেবে সব সময় পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা আর এক ধাপ এগিয়ে বলতে পারি, যাঁদের তেমন কোন সত্যিকারের বন্ধু নেই, তাঁরা সর্বদাই নির্জনতার মধ্যে বাস করেন। কোন বন্ধু ছাড়া পৃথিবী তো আসলে জঙ্গলের মতই। যে মানুষ মন-মানসিকতা এমন যে তার সঙ্গে কারোরই বন্ধুত্ব হয় না, তার স্বভাব আসলে মানুষের মত কম, আর পশুর মত বেশি। জীবনের পথ চলতে গিয়ে আবেগ আর অনুভুতির কত সঞ্চয় জমা হয়ে থাকে মনের মাঝে, জমে থাকে অনেক ব্যাথা ও বেদনা। প্রকৃত বন্ধুর কাছে মন খুলে বলা যায় সেসব কথা। মনের ভার অনেক লাঘব হয় তাতে। আমরা জানি রক্তপ্রবাহ ইত্যাদি শারীরিক ব্যাপারগুলি অবরুদ্ধ থাকা, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে থাকা, শরীরের পক্ষে এগুলি বিপজ্জনক অসুখ। মনের ব্যাপারটাও তার থেকে আলাদা কিছু নয়।

শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরই স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি রুদ্ধ হলে তার ওষুধ আছে, যকৃৎ, প্লিহা, ফুসফুস সব কিছুর আলাদা আলাদা ওষুধ, কিন্তু মনের রুদ্ধতার খোলবার জন্য, সেখানে বন্ধ হয়ে আসা প্রাণবায়ুকে ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার একজন সত্যিকারের বন্ধু। এমন একজন সহানুভূতিশীল বন্ধু যাকে সকল দুঃখ, আনন্দ, ভয়, আশা আর সন্দেহের কথা মুখ ফুটে বলা যায়। যে, সমস্ত বোঝার ভারে অবদমনিত হয়ে থাকে, মন কোন কিছু আশঙ্কা ছাড়াই নির্ভয়ে সে সব কথা জানানো যায় যাকে, কারণ এভাবে বলতে পারলে অনেকটা দূর হবে এইসব মানসিক যন্ত্রণা।

অনেক মহান সম্রাট ও রাজারা বন্ধুত্বকে কত মূল্য দিয়েছেন তা দেখলে অবাক হতে হয়- অনেকে তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও খ্যাতির ওপর ঝুঁকি নিয়েও তাঁদের বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব পালন করে গেছেন। একজন রাজা বা রাজপুত্রের জীবনযাত্রা অন্য সব মানুষের থেকেই অনেক দূরের ব্যাপার। সুতরাং অনেক সময় অসুবিধা সহ্য করেও তেমন কাউকে আলাদা করে নিজের কাছাকাছি তাঁর বন্ধুত্বের উপযুক্ত করে একই সঙ্গে বড় করে না তুললে বন্ধুত্বের ফলভোগ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। সমসাময়িক ভাষায় তাঁদের বলা হয় 'প্রিয়পাত্র' বা 'নিজস্ব বন্ধু' (Privado)- যেন তাদের প্রতি শুধুই দাক্ষিণ্যের বশে এমন নৈকট্য গড়ে উঠেছে। রোমানদের কাছে এমন বন্ধুত্বের নাম ছিল 'পার্টিসিপোস কিউরেরাম' অর্থাৎ 'দুশ্চিন্তার ভাগীদার'- এটাই বরং ছিল সত্যের অনেক কাছাকাছি সম্বোধন। কারণ আশঙ্কার এই ভাগ নিয়ে নিশিদিন সহগমনই ছিল তাদের আসল বন্ধন। আমরা দেখতে পাই এমন বন্ধুত্ব যে শুধু দুর্বল ও আবেগপ্রবণ রাজপুত্ররাই করেছেন তা নয়, সব থেকে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের মধ্যেও তা আছে। তাঁরা অনেক সময়েই তাঁদের কোন সেবককে বন্ধু বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।

তারপরে দুজনেই পরস্পরকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন এবং অপরকেও তাদের এমনভাবেই দেখতে বলেছেন, দুজন অত্যন্ত কাছাকাছি মনের মানুষকে যেভাবে দেখা উচিত সেভাবে। রোমের সম্রাট লুচিয়াস সীলা তাঁর সহযোগী পম্পেকে এত স্বাধীনতা দিয়েছেন যে ক্ষমতার ব্যবহারে সে তাঁকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একবার সীলার অনুমতি ছাড়াই একজনকে শাসক নিযুক্ত করায় তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন। তখন পম্পে তাকে প্রায় চুপ করিয়ে দেয়। 'মানুষ সকালের সূর্যকে অন্তগামী সূর্যের থেকে বেশি মান্য করে' সীলাকে এই কথাই বলেছিল পম্পে। ডেমিনাস ব্রুটাসকে জুলিয়াস সীজার এত পছন্দ করতেন যে তাঁর উইলে নিজের ভাইপোর পরেই ক্ষমতার উত্তরাধীকারে তার নাম ছিল। অথচ এই সেই মানুষ যে ক্ষমতাবান সঙ্গী সাথীদের নিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল। যখন সীজার স্ত্রী ক্যালফুনিয়ার দেখা এক দুঃস্বপ্নকে কথা শুনে এবং আরও কিছু কিছু অশুভ লক্ষণ দেখে, সেনেটের অধিবেশন স্থগিত রাখতে চেয়েছিলেন, তখন এই মানুষই ধীরে ধীরে তার হাত ধরে তার আসন থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আর ব্যঙ্গের সুরে বলেছিল যে সে আশা করে যে সীজার তাঁর স্ত্রী আর একটা শুভস্বপ্ন না দেখা অবধি সেনেটের অধিবেশন বন্ধ করবেন না। সিজারের ওপর ব্রুটাসের প্রভাব এত বেশি ছিল যে এন্টোনিয়াস সিজারের ফিলিপিক্সের সামনে পাঠকরা একটি লেখায় তাকে মন বিষিয়ে দেওয়া ডাইনিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার নিচু বংশে জন্ম নেওয়া আগরিপ্পাকে আগাস্টাস এমন উঁচুতে তুলেছিলেন সে যখন তিনি তাঁর মেয়ে জুলিয়ার ব্যাপারে মেসেনার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন তখন মেসেনা বলেছিলেন যে হয় জুলিয়ার বিয়ে আগরিপ্পার সঙ্গেই হওয়া উচিত, না হলে আগরিপ্পা এমন ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে যে এবার তাকে মেরে ফেলাই ভাল, আর তৃতীয় কোন পথ নেই। একই রকমভাবে টিবেরিয়াস সিজারের সহচর সীজেনাস তাঁর এত কাছাকাছি ছিলেন যে তাঁদের দুজনকে বন্ধু বলা হত এবং ভাবাও হত তাই। টিবেরিয়াস সীজেনাসকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেনও যে 'আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের কথা বিবেচনা করে তোমাকে আমি কিছুই লুকাই নি'। তাঁদের বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান জানাতে রোমের সেনেট তাদের দুজনের মর্মরমূর্তি একসঙ্গে অধিবেশনকক্ষের বেদীতে রাখবার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল। এরকমই গভীর বন্ধু সম্পর্ক এক সময় ছিল সেপ্টিমিয়াস আর প্লাটিনাসের মধ্যে। সেপ্টিমিয়াস তাঁর বড় ছেলের বিবাহ প্রায় জোর করেই প্লাটিনাসের কন্যার সঙ্গে দেন। কিন্তু বরের এক্ষেত্রে কনে পছন্দ হয়নি এবং সে প্রায়ই স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করত। এরকম সময় সেপ্টিমিয়াস ছেলেরই বিপক্ষে দাঁড়াতেন। তিনি একসময় প্লাটিনিয়াস সম্বন্ধে সেনেটকে লিখেওছিলেন- 'এই মানুষটিকে আমি এমন চোখে দেখি যে আমি চাই সে যেন আমার থেকেও বেশি দিন বাঁচে।'

যদি এই সব রাজা ও রাজপুত্রেরা প্রত্যেকেই ট্রাজান বা মার্কাস অরেলিয়াসের মত মহৎ প্রকৃতির মতন হতেন তাহলে না হয় তাঁদের বন্ধুবৎসলতার কারণ বোঝা যেত। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই মহত্ত্বের অধিকারী ছিলেন না বরং নিজেরা এত বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী এবং দৃড়প্রকৃতির ছিলেন আর নিজেদেরই এত বেশি ভালবাসতেন তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই বন্ধুত্বের বন্ধনে বিশেষ বিশেষ লোককে আটকে রাখতেন, কারণ তাঁদের অজস্র সুখ আর বিলাসীতা শুধু একা একা উপযোগ করা হলে তা সম্পূর্ণ হত না। তাকে পরিপূর্ণভাবে উপযোগ করতে বন্ধুর প্রয়োজন ছিল। আরও বেশি ভাববার বিষয়- এইসব রাজা-রাজপুত্রের নিজেদের স্ত্রী-পুত্র, ভাইপো-ভাগনে, সবই ছিল। কিন্তু একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু যে সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের সম্পর্ক দিতে পারে না তা এদের কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব হয়নি।

এই সঙ্গে মনে করা যেতে পারে ফরাসি ঐতিহাসিক কোমিনিউসের লেখা তাঁর প্রথম নিয়োজক বার্গান্দির ডিউক চার্লসের কথা। কোমিনিউস লিখেছিলেন যে চার্লস স্পর্শকাতর বিষয়ে তার জানা কোন কথা কাউকে বলতেন না। আর যে গুপ্তকথা তাকে কষ্ট দিচ্ছে তাকে প্রকাশ করা তাঁর একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। আবার তিনি লিখেছিলেন যে পরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাছাকাছি আসাতে তাঁদের সম্পর্ক বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোমিনিউস তাঁর দ্বিতীয় নিয়োগকর্তা একাদশ লুইয়ের কথাও বলতে পারতেন। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বও শেষমেশ কোমিনিউসের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে পিথাগোরাসের উক্তি অনেকটাই রহস্য আবৃত- 'কোর নে এডিটো', অর্থাৎ নিজের হৃদয়কে খেয়ে ফেলো না। কঠিন ভাষায় বলা কথাটা কিন্তু সত্য। যারা বন্ধু ভেবে অন্যকে তাদের হৃদয় উন্মুক্ত করে দেন আর এক হিসেবে দেখতে গেলে তারা খেয়েই ফেলেন নিজের হৃদয়কে (বেকন পিথাগোরাসের মন্তব্যের এই ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু প্লুটার্ক আবার একই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করেছেন 'তোমার হৃদয়কে অনর্থক চিন্তায় ভারাক্রান্ত করো না'। -অনুবাদক)।

বন্ধুত্বের প্রশংসনীয় দিকগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে একথা প্রথমেই বলতে হয় যে মন খুলে বন্ধুর কাছে প্রকাশ করলে আনন্দ দ্বিগুণ হয় আর দুঃখ হয়ে যায় অর্ধেক। এটা যেন প্রাচীনকালের আলকেমিস্টদের কথিত এমন একটা পরশমণি যা অসুস্থ শরীরকে সুস্থ আর সুস্থ শরীরকে আরও সুন্দর করে তুলত। তারা বলতেন পরশমণি প্রয়োজনে যা অশুভ তার বিপরীত দিকে আর যা শুভ তার পক্ষে কাজ করে, আর ফলাফল হয় সর্বদাই শুভ। কিন্তু আলকেমিস্টদের খুব বেশি তারিফ না করেও, প্রকৃতির স্বাভাবিক কাজ কর্মেও আমরা একই ধর্ম লক্ষ্য করতে পারি। সংখ্যায় বেশি হলে জোর আসে বেশি আর আঘাত লাগে কম। শরীরে যেমন, মনেও তেমনই।

বন্ধুত্বের প্রথম প্রাপ্তি যদি হৃদয়ের আবেগের ক্ষেত্রে হয়, দ্বিতীয়টি তবে বোধ ও চিন্তার ক্ষেত্রে। বন্ধুত্ব যেমন দুঃখের দিনে মনের মধ্যে ঝড়-ঝঞ্ঝা ও দুর্যোগকে শান্ত করতে পারে, তেমনই বন্ধুর সমস্যাসঙ্কুল মনকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে পারে সে। বিশৃঙ্খল চিন্তাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে এক বন্ধু অপরকে সাহায্য করতে পারে। একজন বন্ধু যে ভাল পরামর্শ দেবে সেটাতো আশাই করা যায়। তাছাড়াও যে মানুষের মন নানা চিন্তা ভাবনায় বিপর্যস্ত সে আর একজনের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করলে তার নিজের চিন্তা ভাবনাও অনেক পরিস্কার হয়। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করলে সে তার চিন্তাগুলোকে আরও সহজে সামনে আনতে পারে, প্রকাশ করতে পারে তাদের। কোন ধারণাকে বাক্যে প্রকাশ করলে আরও পরিষ্কারভাবে দেখা যায় তাকে। এটা নিশ্চিত যে সারাদিন নিজের মনে কোন সমস্যা চিন্তা করার থেকে সেটা সম্বন্ধে এক ঘন্টার আলোচনা অনেক সময়েই বেশি কাজের হয়। এথেন্সের সেমিস্টেক্লেস পারস্যের রাজাকে এই কথাটি বড় সুন্দরভাবে বুঝিয়ে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন- উচ্চারিত বাক্য হচ্ছে ফ্রান্সের আরাসে বয়ন করা বিশেষ কাপড় সামনে ছড়িয়ে দেওয়ার মত, তখন তাদের মধ্যে নানা সুক্ষকাজ ও চিত্র বিচিত্র নক্সা সব কিছুই নজরে আসে। আর শুধুই মানসিক চিন্তা হচ্ছে এই কাপড়গুলোই যখন পাট করে একের পর এক সাজিয়ে রাখা থাকে তেমন।

বন্ধুত্বের দ্বিতীয় প্রাপ্তির আর একটা খুব সহজভাবে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে বন্ধুর থেকে পাওয়া সৎ ও বিশ্বস্ত পরামর্শ। হেরাক্লিটাসের একটি মন্তব্য আছে- 'যে মন কম প্রভাবিত তার চিন্তাই পরিষ্কার হয়।' বন্ধুর পরামর্শের ব্যাপারে এটা খুবই সত্য। কারণ মানুষ নিজে যখন সমস্যার মধ্যে আছে তার চিন্তা ভাবনা আবেগপ্রবণ ও বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। বন্ধুর উপদেশ তেমনভাবে প্রভাবিত হবে না। তুলনায় নিজেকে দেওয়া নিজের পরামর্শ অনেক সময়ই চাটুকারিতা হয়ে দাঁড়াবে। মানুষের নিজের প্রতি নিজের এই চাটুকারিতার সব থেকে ভাল ঔষধ হচ্ছে একজন বন্ধুর স্বাধীন মতামত ও মন্তব্য। পরামর্শ দুরকম বিষয় নিয়ে হতে পারে। এক হচ্ছে নীতি নিয়ে, নৈতিকতা নিয়ে, আর দুই দৈনন্দিন ব্যবসা বাণিজ্য ও ব্যবহারিক জগৎ নিয়ে। প্রথম ক্ষেত্রে মনকে সুস্থ নৈতিকতার সীমার মধ্যে রাখার জন্য একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর পরামর্শই হচ্ছে সেরা সীমান্তরক্ষক।

যে অন্যায় করছে তার জন্য বাইরের লোকের নিন্দা আর কঠোর সমালোচনা অনেক সময় অত্যাধিক তীক্ষ্ণ ও সহানুভূতিশূণ্য হওয়ার জন্যই কোন কাজের হয় না। নৈতিকতার বইটাই পড়াটাও নিষ্প্রাণ ও নিরুত্তাপ। অন্য লোকে একই অন্যায় করছে- তাই দেখেও মানুষের সংশোধিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বন্ধুর মৃদু ভর্তসনা ও সতর্কীকরণই এক্ষেত্রে সব থেকে ভাল ওষুধ। দেখে অবাক লাগে, অনেকেই বিশেষত বড় বড় মানুষেরা, তাঁদের নাম, যশ এবং সৌভাগ্যের জন্য ক্ষতিকর কত রকম বিরাট ভুল আর উদ্ভট কাজ করতেই থাকেন শুধু এই ভুল ধরিয়ে দেবার মত কোনও বন্ধু তাদের পাশে নেই বলে। সেন্ট জেমসের একটি মন্তব্য আছে যে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা আয়নায় নিজের প্রতিকৃতিকেও চিনতে পারে না। এই রকমই নিজেকে চিনতে অনেক মানুষ ভুল করেন। এবার দৈনন্দিন কাজ, কর্ম ও ব্যবহারিক জগতের প্রসঙ্গে আসে। কেউ এ কথা ভাবতেই পারেন একটা চোখ দিয়ে যা দেখা যায়, দুটো চোখেও ওই একই জিনিস দেখতে পাওয়া যায়, অথবা একজন খেলোয়াড় একজন দর্শকের থেকে অনেক বেশি দেখেন, অথবা বন্দুক ছুঁড়তে গেলে বুকের ওপর কথা- দুনিয়াতে যেন তার আর কাউকে দরকার নেই।

এসব কথার পরেও, এটাই সত্য থেকে যায় যে সঙ্গে ভাল পরামর্শদাতা থাকলে ব্যবসা বাণিজ্যও ভাল চলে। আবার কেউ যদি এমন ভাবেন একটা একের পরামর্শ নেবেন তো আরেকটায় আরেক জনের, তার থেকে কারও পরামর্শই না নেওয়া ভাল। কারণ এই রকম নানা জায়গায় দৌড়ানোর মধ্যে দুটি বিপদ আছে। প্রথমটি হচ্ছে যদি পরামর্শদাতা নেহাতই তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু না হন তাহলে এমন পরামর্শ দিতে পারেন যার মধ্যে হয়ত কোন লুকানো জটিল উদ্দেশ্য থাকবে যাতে পরামর্শদাতারই লাভ হল। অথবা পরামর্শদাতার যেহেতু তাঁর সম্বন্ধে বা তাঁর ব্যবসা বাণিজ্য সম্বন্ধে খুব ভাল করে জানা নেই তাই ভাল মনে দেওয়া উপদেশও হয়ত কিছু উপকারী আর কিছু ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াল। অনেকটা অপরিচিত কোন চিকিৎসককে দিয়ে করানোর মত। যেহেতু তাঁর রোগীর শরীর সম্বন্ধে আগে থেকে ভাল করে জানা নেই, তাঁর ওষুধে হয়ত একদিকে অসুখ ভাল হল, আর একদিকে এমন জটিলতার সৃষ্টি হল যে আর সামলানই গেল না- রোগ ভাল হল বটে কিন্তু রোগী মারা গেল। কিন্তু একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু যিনি কোন ব্যক্তির সম্পূর্ণ ব্যবসা বাণিজ্য সম্বন্ধে ধারণা রাখেন তিনি সাবধানে পরামর্শ দেবেন। তিনি খেয়াল রাখবেন যেন ব্যবসার একটা দিক বাড়াতে গিয়ে আরেকটা দিকে কোন বিপত্তি না উপস্থিত হয়। সুতরাং এলোমেলোভাবে পরামর্শ নেবেন না। এমন করলে সুস্থির দিক নির্দেশ পাবেন না- বরং লক্ষ্যচ্যুত এবং পথভ্রষ্ট হবেন।

মানসিক ঝড়-ঝঞ্ঝায় শান্তি আর বিচার বিবেচনায় সমর্থন বন্ধুত্বের এই দুইটি মঙ্গলময় ফলের পরে, আমরা তার শেষ ফলটির কথায় আসি- এটি প্রায় অনেক দানায় ভরা ডালিম ফলের মত।

আমি বলছি আসলে সমস্ত বিষয়ে ও প্রয়োজনেই একজন বন্ধু তার বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে পারে। বন্ধুত্বের বহুবিধ মঙ্গলময় সম্ভাবনা উপলব্ধি করার একটা পথ হচ্ছে আমরা নিজেরা কী কী করতে পারি না সেগুলো একটু ভেবে দেখা। তার পরে মনে হবে প্রাচীনরা যে বলেছিলেন যে 'বন্ধু হচ্ছে মানুষের অন্য আর একটা অস্তিত্ব' তা যথেষ্ট নয়, আসলে বন্ধু মানুষের অন্য আরেকটা অস্তিত্বের থেকেও বেশি। পৃথিবীতে মানুষের প্রাপ্য দিনগুলো বড় গোণাগুণতি, বড় অনিশ্চিত- হয়ত মনের অনেক ইচ্ছাকে অপূর্ণ রেখেই চলে যেতে হয় আমাদের। সন্তানকে বড় করা, কোন বিশেষ আরব্ধ কাজকে সমাপ্ত করা- ইত্যাদি কত কাজ থাকে আমাদের। সত্যিকারের কোন বন্ধু থাকলে মানুষ নিশ্চিত হতে পারে যে তার মৃত্যুর পরেও সেগুলো সম্বন্ধে যত্ন নেওয়া হবে। এমন সৌভাগ্যবান মানুষের যেন একটা নয়, দুটো জীবন আছে। আমরা সবাই আমাদের শরীরের মধ্যে আবদ্ধ, আর শরীর কেবল এক জায়গাতেই থাকতে পারে। কিন্তু বন্ধুত্বের সৌভাগ্য সৌভাগ্যবান যে, তার যেন আরেকটা শরীর আছে যে তার সহযোগী, কারণ বন্ধুও তার অনেক কাজ করে দিতে পারে।

এমন কত কিছুইতে আছে যা মানুষের নিজের জন্য নিজের পক্ষে করা অসুবিধাজনক। অনেক জায়গাতেই নিজের গুণ বা কৃতিত্বের কথা নিজে বলাই যায় না, নিজের প্রসংসা করাতো আরও দূরের ব্যাপার। নিজের জন্য কোন জিনিস কারও কাছে প্রার্থনা করতে যাওয়াও অনেকের কাছে কষ্টকর। এই জাতীয় সব কিছুই যা নিজে বলতে গেলে বিব্রত হতে হয়, একজন বন্ধু সেই কথাগুলি অনায়াসে সুন্দরভাবে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারে। আবার মানুষের নিজস্ব সম্পর্কগুলো কথা বলার সময় সামনে এসে দাঁড়ায়। মানুষ পুত্রের কাছে পিতা হিসেবে ছাড়া কথা বলতে পারে না, স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপে সর্বদাই সে স্বামী আর শত্রুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে সর্বদাই শর্ত এসে পড়ে।

এই সমস্ত জায়গাতেই বন্ধু তার কথাগুলো ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন ছাড়াই নিরপেক্ষভাবে পৌঁছে দিতে পারে। লিখতে গেলে এমনই অসংখ্য সব কথা মনে পড়ে যায়। আমি এতক্ষণ এই পৃথিবীর নাট্যশালায় পাত্রপাত্রীদের পালনীয় একটি নিয়মের কথা বলেছি। বন্ধুহীন মানুষ এখানে একেবারেই বেমানান। তার বরং নাট্যমঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়াই ভাল।

সমাপ্ত