Thursday, July 26, 2012

ধর্ম এবং বিজ্ঞান

লেখকঃ আলবার্ট আইনস্টাইন
মানুষ আজ পর্যন্ত চিন্তায় ও কর্মে যা কিছু অর্জন করেছে সবই হয় কোন গভীর ভাবে অনুভূত প্রয়োজন মেটাতে অথবা কোন যন্ত্রণা এবং কষ্ট লাঘবের জন্য। আধ্যাত্মিক ভাবনা-চেতনা, সেই সংক্রান্ত আন্দোলনসমূহ এবং তাদের বিবর্তন ও অগ্রগতি ভালভাবে বোঝবার জন্য এই কথাটা সব সময় মাথায় রাখতে হবে। অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা, তা আমাদের সামনে যে মহৎ আবরণেই উপস্থিত হোক না কেন মানুষের সকল চেষ্টা ও সৃষ্টির পিছনে সেই হচ্ছে সঞ্চালনী শক্তি। তাহলে ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাসের পিছনে মানুষের কোন প্রয়োজন, আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি কাজ করেছে? এসব শব্দগুলির বৃহত্তর অর্থকে মনে রেখে আমরা এখন তা ভেবে দেখতে পারি। একটু বিচার বিবেচনা করলেই দেখা যাবে ধর্মীয়চিন্তা ও অভিজ্ঞতার ওপরে মানুষের বিচিত্র সব আবেগের প্রভাব আছে।

অনেক অনেক দিন আগের মানুষের কাছে সব কিছুর আগে ভয়ই ছিল ধর্মীয় ধ্যান ধারনার জন্মদাতা - ক্ষুধার ভয়, বনের জন্তু জানোয়ার, অসুখ মৃত্যু - এসব কিছুই ভয়ের কারন ছিল। সেই সময়ে কার্য কারণের সম্পর্ক আমরা খুব কমই বুঝতাম, সেজন্য মানুষের মন তার নিজেরই মত চেহারার বিভিন্ন অস্তিত্বের কল্পনা করেছিল-যাদের ইচ্ছা এবং কাজ এই সব ভীতিপ্রদ ঘটনাগুলো ঘটায়। সেই জন্য বিভিন্ন ক্রিয়া কর্ম ও বলিদান ইত্যাদি বংশানুক্রমে চলে আসা বিভিন্ন পদ্ধতি দ্বারা তাদের খুশি করা অথবা কোন ব্যক্তি মানুষের প্রতি ক্ষতিকারক না হওয়ার জন্য চেষ্টা করা হত।

এই অর্থেই আমি ভয়ের দ্বারা প্রতিপালিত ধর্মের কথা বলেছি। পূজারী বা যাতক শ্রেণী, যারা এই সব ভীতিসঞ্চারী অস্তিত্ব এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী হিসেবে আবির্ভূত হন তাঁরা নিজেরা এই আতঙ্কের স্রষ্টা নন, কিন্তু তাঁরা এই আতঙ্কে একটা স্থায়ী রূপ দেন এবং তাঁদের একটা একাধিপত্য এরই ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। অনেক সময় এও দেখা যায় যে একজন নেতা, অথবা শাসক অথবা বিশেষ সুবিধাভোগী কোন শ্রেণী, সমাজে যাদের স্থান আসলে অন্য কারণে তৈরি হয়েছে, তাঁরা নিজেদের ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সংশ্রবরহিত অন্যান্য ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সঙ্গে পূজারীদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজকর্মও যুক্ত করে নেন। তাতে তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আরও দৃঢ় হয়। অন্যভাবে বললে, রাজনৈতিক শাসক ও যাতক শ্রেণী তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই অভিন্নভাবে কাজ করেন।

সামাজিক প্রবৃত্তি থেকে ধর্ম তার রূপ নেয়। বাবা-মা অথবা বৃহত্তর মানব গোষ্ঠির নেতারা - এঁরা কেউই সর্বদা অভ্রান্ত নন এবং প্রত্যেকে মরনশীল। সঠিক পথনির্দেশ পাবার আকাংক্ষা, ভালবাসা এবং মানসিক সমর্থনের চাহিদা তাই ঈশ্বর সম্বন্ধে সামাজিক ও নৈতিক ধারনা গড়ে তুলতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই ঈশ্বর হচ্ছেন আমাদের নিয়তি, যিনি রক্ষা করেন, ধ্বংসও করেন, পুরস্কারও দেন এবং শাস্তিও দেন। বিশ্বাসী মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির সীমা অনুযায়ী তিনি মানবিক কোন গোষ্ঠি অথবা সম্পুর্ন মানব জাতীকে ভালবাসেন এবং তাদের জীবনধারা প্রবাহিত রাখেন। কখনও কখনও জীবনের সমস্ত ধারারই তিনি প্রতিপালক, সমস্ত দুঃখে ও অতৃপ্ত ইচ্ছা পূরনে তিনিই সান্তনা স্বরুপ, সমস্ত মৃত মানুষের আত্মা তাঁরই তত্ত্বাবধানে গচ্ছিত থাকে। ঈশ্বর সম্বন্ধে সামাজিক ও নৈতিক ধারনার এই হচ্ছে গোড়ার কথা।

ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থসমুহে ভয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ধর্ম থেকে নৈতিক ধর্মের এই পরিবর্তন খুব ভালভাবে দেখা যায়। এই বিবর্তন পরে নিউ টেস্টামেন্টেও বিস্তৃত হয়েছে। সভ্যজগতের সমস্ত মানব গোষ্ঠির বিশেষত প্রাচ্যের মানুষদের অনুসৃত ধর্ম মুলত নীতিমালাভিত্তিক, আতংকের ধর্ম থেকে নীতির ধর্মের এই বিবর্তন মানুষের অগ্রগতিরই পরিচায়ক। কিন্তু তবুও প্রাচীন মানুষের ধর্ম সবটাই ভয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আর পরবর্তী সভ্যজগতের ধর্মের সব কিছুই নীতিভিত্তিক এরকম কোন বদ্ধমুল ধারনা এবং কুসংস্কার সম্বন্ধে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। আসলে, সত্য হল এই যে ধর্মের ভয়ভিত্তিক ও নীতিভিত্তিক এই দুই মুলগত চরিত্রের মিশ্রন আছে। তবে যেখানে সামাজিক জীবন যত উচ্চস্তরের নীতিভিত্তিক ধর্মের প্রভাব সেখানে তত বেশি।

ধর্মের এই বিভিন্ন প্রকারভেদের মধ্যে সাধারণভাবে ঈশ্বরের ধারণা মানবকেন্দ্রিক বা মানবিক। কেবলমাত্র অসাধারণ মানসিকতাসম্পূর্ণ মানুষ অথবা জনগোষ্ঠিকেই এই প্রকার ধারণার ঊর্ধে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু এই সমস্ত ছাড়াও তৃতীয় এক প্রকার ধর্মীয় অনুভূতি সব ধর্মেই সম্ভব হতে পারে-যদিও বিশুদ্ধ চেহারায় তার দেখা পাওয়া হয়ত বিরল ঘটনা। আমি এটাকে বলব 'মহাজাগতিক ধর্মীয় চেতনা।' যিনি এটাকে মোটেই অনুভব করেননি তাঁর কাছে এটা ব্যাখ্যা করা মুস্কিল, কারণ মানবিক বা মানবকেন্দ্রিক ঈশ্বরের অনুভূতির সঙ্গে এই চেতনার কোন সংযোগ নেই।

যার মধ্যে এই চেতনা আসে তিনি বিশ্বব্রক্ষ্ণাণ্ডের সর্বত্র এক ভাবগম্ভীর শৃঙ্খলা বোধ যা প্রকৃতি ও চিন্তাজগৎ সবখানেই পরিব্যাপ্ত তা অনুভব করেন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাশার তুচ্ছতাও হৃদয়ঙ্গম করেন। তখন শুধুই নিজেকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা, যা আমাদের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব, তাকে মনে হয় কারাগারে আবদ্ধ এক বন্দীর মতন। বিশ্বের সর্বময় পরিব্যাপ্তিকে একই সঙ্গে অনুভব করতে উদ্বুদ্ধ হয় মন, এই মহাজাগতিক ধর্মীয় চেতনার প্রাথমিক প্রকাশ আমরা অপেক্ষাকৃত প্রাচীন রচনাতেও দেখতে পাই, যেমন ডেভিড ও অন্য কয়েকজন ধর্মপ্রচারকের স্তোত্রে। শোপেনহাওয়ারের লেখা থেকে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, সেখানেও এই অনুভুতির জোরালো প্রকাশ রয়েছে।

সকল যুগের যেসব প্রতিভাশালী ব্যক্তি ধর্ম নিয়ে চর্চা করেছেন তাঁরা প্রতেকেই এই ধরনের চেতনা অনুভব করেছেন যা সমস্ত গোঁড়ামির ঊর্ধে। যেখানে ঈশ্বরকে মানুষের আদলে চিন্তা করা হয়নি, তাই চার্চের মত উপদেশদানকারী কোন কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সেখানে স্থান নেই।

তাই সকল যুগের প্রচলিত ধর্ম মতের বিরোধী কিছু মানুষের মধ্যেই আমরা এই চেতনা দেখতে পেয়েছি এবং তাঁদের কাউকে নাস্তিক আবার কাউকে জ্ঞানী পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই আলোকে বিচার করলে ডেমোক্রিটাস, আসিসির অধিবাসী ফ্রান্সিস অথবা স্পিনোজা একই ধরনের মানুষ ছিলেন। এই মহাজাগতিক ধর্মীয় অনুভুতিতে কোন নির্দিষ্ট ঈশ্বর বা তত্ত্বকথার ধারনা নেই, তাহলে কেমন করে তা একের থেকে অন্যের কাছে পৌঁছুবে? আমার মতে এই চেতনাকে জাগিয়ে রাখা বিজ্ঞান ও শিল্পের অন্যতম প্রধান অর্জন হতে পারে।

এভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞান ও ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ককে অভ্যস্ত ধারনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রায় দেখতে পারা যায়। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, বিজ্ঞান ও ধর্ম যে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর অধিবাসী দুই বিরোধী বিষয়বস্তু এটাই মনে হওয়াই স্বাভাবিক। বিশ্বব্রম্ভান্ডের ঘটনাস্রোতে কার্যকারন সূত্রের প্রয়োগে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী কোন মানুষই মাঝখানে কোন অস্তিত্ব সেই ঘটনা ক্রমকে ইচ্ছামত পরিবর্তিত করতে পারে এটা মেনে নিতে পারে না।

এই ধরনের যুক্তিবাদী মানুষের কাছে ভয়ের ওপর ভিত্তি করে ওঠা ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই, সামাজিক ও নৈতিক ধর্মও তার কাছে একই মূল্য রাখে। পুরস্কৃত করেন অথবা শাস্তি দেন এমন কোন ঈশ্বর তার ধারনাতে আসবেনা। কার্যকারণ সম্পর্কের যুক্তিতে মানুষ যা কিছু করে তার সবই তার নিজস্ব পূর্বনির্দিষ্ট প্রয়োজন অথবা বাইরের কন অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন মেটাতেই। সুতরাং নিষ্প্রান বস্তুসমুহ তাদের গতি প্রকৃতির জন্য যেমন নিজেরা দায়ী নয়, ঈশ্বরের বিচারে মানুষের কৃতকর্মের জন্য দায়িত্বও তার থেকে বেশী কিছু হওয়া উচিৎ নয়।

এই সব যুক্তি উপস্থিত করে বিজ্ঞান নীতিবোধের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে এই রকম একটা অভিযোগ করা হয়েছে - কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অভিযোগ ন্যায়সঙ্গত নয়। মানুষের নৈতিক ব্যবহার নির্ধারিত হওয়া উচিৎ তার সহানুভুতি, শিক্ষা, সামাজিক বন্ধন ও প্রয়োজন - এ সবের উপর ভিত্তি করে। এর জন্য ধর্মীয় শাস্তির ভয় অথবা পুরস্কারের আশা দিয়ে নিয়ন্ত্রন করতে হয় তবে বুঝতে হবে মানুষের পরিস্থিতি দুঃখজনক।

তাই চার্চ কেন সর্বদাই বিজ্ঞানের সঙ্গে লড়াই করেছে এবং তার অনুগতদের শাস্তি দিয়েছে তা অনুধাবন করা সহজ। অপর পক্ষে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই মহাজাগতিক ধর্মিয় অনুভুতি বিজ্ঞান গবেষনার জন্য সর্বাধিক প্রেরনাদায়ী মহত্তম চালিকা শক্তি। বিজ্ঞানের কোন নতুন তত্ত্বগত ধারনা নিয়ে মৌলিক দিগনির্দেশক গবেষনা করতে গেলে গভীর নিষ্ঠা, অসাধারন চেষ্টা ও পরিশ্রমের প্রয়োজন। যারা এই নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টা সম্বন্ধে প্রকৃত ধারনা রাখেন, শুধু তাঁরাই বুঝতে পারবেন যে কি পরিমান আন্তরিক আবেগ থাকলে তবে দৈনন্দিন আপাত দৃশ্য জগৎ থেকে দুরে শুধু গভীর কোন তাত্ত্বিক ধারনা নিয়ে এভাবে সুদীর্ঘ সময় ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা যায়।

কেপলার আর নিউটনের কথা ভেবে দেখুন। মহাবিশ্বে ধাবমান প্রহ নক্ষত্রের গত প্রকৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করবার সুগভীর আকাঙ্ক্ষা থাকলে তবেই এই রকম সাধনা করা সম্ভব। বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে যাঁদের ধারনা শুধু তার ব্যবহারিক ফল ও প্রয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ তাঁরা গবেষণা কাজে নিয়োজিত এসব নিবেদিত প্রাণ মানুষের মন-মানসিকতা সম্বন্ধে সহজেই ভুল ধারনা করে থাকেন। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে চারদিকে সন্দেহ ও বিরুদ্ধতার মধ্যে অটল বিশ্বাসের একই মানসিকতা নিয়ে তাঁরা সবাই কাজ করে গেছেন। যে সমস্ত মানুষ তাঁদের সারা জীবন এই রকমই কোন কাজে নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়োজিত থেকেছেন, শুধু তাঁরাই এই সব গবেষক ও কর্মীদের সংখ্য ব্যর্থতা সত্ত্বেও মূল লক্ষ্যে অবিচল থাকার প্রেরনা ও তার শক্তি সম্বন্ধে কোন পরিষ্কার উপলব্ধি পেতে পারেন। শুধুমাত্র এক মহাজাগতিক ধর্মীয় অনুভুতিই তাদের এই শক্তি দিতে পারে। আমাদের সমসাময়িক কোন মনীষী ঠিকই বলেছেন যে আমাদের এই বস্তুতান্ত্রিক যুগে একমাত্র নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানকর্মীরাই হচ্ছেন সবচেয়ে ধার্মিক মানুষ।

সমাপ্ত