Thursday, July 26, 2012

দেকার্ত-এর সঙ্গে দশ পা

লেখকঃ মিহির চক্রবর্তী
আমি ভাবছি, তাই আমি অস্তিত্ববান। কেন্দ্রে এই আমি, আমাকে ঘিরে আকাশ বাতাস ভুমন্ডল - প্রতিটি 'আমি' এক একটি ভুমন্ডলের কেন্দ্র। এবং আমি মানেই মানুষ আমি। পক্ষী-আমি নই, বৃক্ষ-আমি নই, নদী-আমি নই।

নদীরা বৃক্ষেরা তো নয়ই, মনুষ্যেতর প্রানীরাও অনুভবহীন, বিচারবোধহীন। তাদের চলাফেরা ঘড়ির কাঁটার মতো, প্রাণস্পন্দনরহিত, তারা অটোমেশন। এই দেকার্ত, আধুনিকতার জনক রেনে দেকার্ত।

বিপরীতে সু-সমাচার-কে স্মরণ করা যেতে পারে এখানে - (দেকার্ত-সৃষ্ট) 'আধুনিক' মানুষ প্রকৃতির অংশ হিসাবে নিজেকে অনুভব করে না, সে নিজেকে বহিরাগত ভাবে এবং মনে করে তার নির্ধারিত কাজ হল প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, তাকে জয় করা।


আমার চারপাশে যে ভুমন্ডল তা প্রকৃত কি না জানিনা, জানবার উপায়ও নেই কোনো - "আমি ভেবে নেবো, আকাশ, বাতাস, বর্ণ, আকার, ধ্বনি ইত্যাদি পার্থিব যত এ সব, তা সরলমতি আমাকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে শয়তানের কুহক আর প্রতারণা।" তাই আমার ভুমন্ডল আমার ভাবনার ও বিচারের তন্তু দিয়েই সৃষ্টি করে নিতে হবে।

এই আমি সরিয়ে নিলাম দৃষ্টি।
এই সরিয়ে নিলাম শ্রবণ।
এই গুটিয়ে নিচ্ছি আমার ইন্দ্রিয়সকল।

আমার চিন্তার শরীর থেকে সমস্ত জাগতিক বস্তুর প্রতিকৃতি মুছে ফেলছি। যদি একান্তই তা সম্ভব না হয় মনে করব সে ছবি মিথ্যা। এবং এভাবেই মুখোমুখি হব নিজের, শুধুমাত্র নিজের সাথে বাক্যবিনিময়ের জন্য।


যদিও এই 'ভাবনা' শুধুমাত্র চিন্তন নিয়ে নয়। আমার ভিতরে যা কিছু ক্রিয়াশীল, যা কিছুর ক্রিয়াশিলতা নিয়ে আমরা সচেতন - বিচারবোধ, ইচ্ছে, কল্পনা এবং অনুভব এ সব কিছু জুড়েই আমাদের 'ভাবনা'।

ভাবনা তাই অস্তিত্বও ।


কিন্তু এই অস্তিত্বের উপস্থিতি বিষয়ে নিঃসন্দেহ হই সর্বগ্রাসী এক অবিশ্বাসের ধারা বেয়ে। আমি বোকার মতো, গোঁয়ারের মতো অবিশ্বাস করতে করতে চলেছিলাম -
আমার হাত-কে পা-কে চোখ-কান-স্পর্শকে,
আমার পূর্বসুরিকে, তাদের লেখাপত্র ভাবনারেখাকে।

এভাবে চলতে চলতে এই নিকষ কালাপাহাড় শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেছে শুধু নিজের অস্তিত্বকে। কারন 'কেউ একজন এই অবিশ্বাসের কর্তা' - এই বোধ নিতান্তই স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট ।

তবে বিশ্বাস শুধুমাত্র অস্তিত্বকেই, বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শকে নয় - এরা তো স্বপ্নেও আসে।


অস্তিত্ব কি একটি ধর্ম? লাল, চৌকো, মিষ্টি অথবা নরম-এর মতো? যখন বলি 'বৃত্তের পরিধির বিন্দুগুলি থেকে সমদুরবর্তী একটিমাত্র বিন্দু আছে, কেন্দ্র' - অর্থাৎ বৃত্তের একটি ধর্মের অস্তিত্ব বলা হল, তখন বৃত্তের কোনো বাস্তব অস্তিত্বও কি স্বীকার করে নিতে হয়? হয়তো নয়। অর্থাৎ গুনাবলী আছে কিন্তু অস্তিত্বটাতেই সংশয়।

অথচ, আমরা যখন প্রার্থিত পাত্রের গুনাবলী বিজ্ঞাপিত করি - মধ্যবয়সী, পত্নীপরিত্যক্ত, কোমল স্বভাব, ক্ষীণতনু - তখন একথা ভুল করেও বলি না যে পাত্রটিকে অস্তিত্ববানও হতে হবে। অস্তিত্ব ধরেই নেওয়া হয় স্বতঃসিদ্ধের মতো।


রবীন্দ্রনাথ -
'সে বলল, চেহারাখানা হারিয়ে ফেলেছি।' ... ... 'পুপেদিদির ঘরে ভোজ, সকাল সকাল নাইতে গেলাম। বেলা তখন সবেমাত্র দেড়টা। তেলেনিপাড়ার ঘাটে বসে ঝামা দিয়ে কষে মুখ মাজছিলুম। মাজতে মাজতে খেয়াল করিনি শরীরটা উঠে যাচ্ছিল একটু একটু করে। কখন যে উঠে গেল সমস্তটাই।

'চুলকুনি ছিল গায়ে, চুলকোতে গিয়ে দেখি, না আছে নখ না আছে চুলকুনি, ভয়ানক দুঃখ হল। হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলুম, কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যে হাউহাউটা বিনামুল্যে পেয়েছিলাম সে গেল কোথায়। যতই চেঁচাই, চেঁচানোও হয় না, কান্না শোনাও যায় না। ইচ্ছে হল মাথা ঠুকি বটগাছটাতে, মাথাটার টিকি খুঁজে পাইনে কোথাও। সবচেয়ে দুঃখ বারোটা বাজল, "খিদে কই" "খিদে কই" বলে পুকুরধারে পাক খেয়ে বেড়াই, খিদে বাঁদরটার চিহ্ন মেলে না।'

দেকার্ত-এর ঠিক বিপরীতটাই চাইছেন রবীন্দ্রনাথ - দেকার্ত যেখানে চাইলেন ধর্মগুলি সরিয়ে সরিয়ে শুধুমাত্র শুদ্ধ 'আছি'তে পৌঁছুতে, 'সে' ব্যাকুল শুধুমাত্র 'আছি' থেকে ধর্মগুলিতে ফিরে যেতে।


অথচ 'আমি আছি'-র যে জোরটা আছে, তা দিয়েই তো কলম্বাস আমেরিকা অভিমুখী হন, মেশিন চলে, জব চার্নক সুতানুটি আসেন, বিদ্যাসাগর ছুটে বেড়ান কলেজ স্ট্রিটের পাড়ায়।


কিন্তু আর একটা কান্নাও তো আছে আমাদের - 'আমি বলে মিলাই আমি আর কিছু না চাই।' এই ক্রমে মিলিয়ে যেতে চাওয়া 'আমি'টার কোন সন্ধান দেকার্ত-এর মধ্যে কোথাও ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায় কি না তার খোঁজ করছি এখন।


তাঁর আশ্চর্য মৃত্যুকাহিনী কি কোন কথা বলবে?

- ইয়োরোপের বিখ্যাত বিদ্যালয় ল্য ফ্লেম থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে তার প্রধান উপলব্ধি হল প্রথাগত শিক্ষা দিয়ে কিছুই হবে না।

- পৃথিবীর পাঠশালা থেকে নিজের বিচারবোধ যুক্তি নির্ভর পাঠগ্রহনই শুধু তিনি চাইলেন।

- প্যারীতে উল্লাসময় জীবন এবং তার পর পরই অন্তরীন থাকা - পালা করে চলেছে কিছুদিন।

- অতঃপর অবৈতনিক যোদ্ধা হিসেবে সেনা ছাউনিতে 'অহিংস' অবসর যাপন - এবং আশ্চর্য, এই অবকাশে সংগীত বিষয়ক একটি নিবন্ধ রচনা।

- স্থায়ী প্রবাসজীবন তারপর থেকে হলান্ড-এ, মুক্তঞ্জানচর্চার আশায় এবং বিভ্রান্তি ও ভ্রান্তির বিরুদ্ধে লড়াই।

- ১৬৩৩, গ্যালিলেও-র 'ডায়লগ' নিষিদ্ধ ঘোষিত হল, তাঁকে অন্তরীন থাকতে ও সপ্তাহে তিন দিন করে অনুতাপ বাক্য আওড়াতে বাধ্য করা হল। তখন হল্যান্ড -প্রবাসী রেনে দেকার্ত উদ্যোগী হয়েছেন একই তত্ত্বের সমর্থনে ল্য ম্যঁদ গ্রন্থ প্রকাশে।

কিন্তু যেহেতু "প্রতিকুল বাতাসে চলা তাঁর স্বভাব নয়" - তাই ল্য ম্যঁদ-এর মুদ্রণ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিলেন তিনি।

- অতঃপর সুইডেন। রাণী ক্রিশ্চিয়ানা পাঠ নিতে চান দর্শনে ও গণিতে। জাহাজ পাঠিয়েছেন। সাড়া দিলেন তিনি। কেন?

রানী পাঠ নেবেন ভোর পাঁচটায়। দেকার্ত, একটু আলসেমি করেই শুয়ে থাকতে ভালোবাসতেন সারা সকালটা, সেভাবেই তাঁর অসামান্য ভাবনাগুলি জমতে থাকত। তিনি পছন্দ করতেন উষ্ণতা, শারীরিক ঊষ্ণতা, স্টোভের প্রায় মধ্যেই বসে কাটাতে ভালোবাসতেন শীতকালটা।

এই দেকার্ত, রানীর ডাকে, অথবা টানে, ভোর পাঁচটায় সুইডেনের রাস্তা ধরে চলেছেন দিনের পর দিন।

অবশেষে এভাবেই মারা গেলেন নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৪ বছর বয়েসে, ১৬৫০-এ।

- অথচ তিনি ১৬৩৮-এর জানুয়ারিতে লিখছেন, একশো বছরের বেশি বেঁচে থাকতে চান; জুন-এ লিখছেন, সত্তর বছর বাঁচলেই চলবে। এবং ১৬৪৫-এ বেঁচে থাকাকে টিকিয়ে রাখার চেয়ে ভালো এবং সহজ আর একটি পদ্ধতি তিনি আবিস্কার করেছেন - মৃত্যুকে ভয় না পাওয়া।

১০
কোনো বৌদ্ধ দার্শনিক তাঁর পরিচিতদের কাছে লিখেছিলেন, 'আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই আমি অমুক দিন থেকে দেহ রাখছি।'

দুঃখ নয়, পরিতাপ নয়, কোনো অন্তিম ইচ্ছের কথা নয়, একটি বিজ্ঞপ্তি শুধু। এবং তিনি মারা গেলেন।

সমাপ্ত